ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বন্যা রোধে খাল খনন কর্মসূচি ফিরিয়ে আনতে হবে

মাহাম্মদ সফি উল্যাহ
বন্যা রোধে খাল খনন কর্মসূচি ফিরিয়ে আনতে হবে

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে খাল খনন কর্মসূচি চালু করেছিলেন। ওই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখা, শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজে সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সহজ যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশের মডেল তৈরি করা। ওই মডেলকে মানুষ ‘জিয়া মডেল’ হিসেবে বিবেচনা করে। ওই কর্মসূচি ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ মডেলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল, যাতে গ্রামের মানুষ খাদ্য বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিনিময়ে খাল খননের কাজে অংশগ্রহণ করেছিল।

এভাবে স্থানীয় জনগণ দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়ে সহানুভূতি, আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলেছিল। এটি আধুনিক যুগে সায়েন্স অ্যান্ড কমিউনিটিভিত্তিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বর্তমানে যেখানে সায়েন্টিফিক মডেল গ্রহণযোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি, সেখানে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী মডেল স্থাপন করেন। এই মডেল বাস্তবায়ন করে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন। যদি এই মডেল চালু থাকত, তবে বর্তমানে বর্ষাকালে প্রতিবছর হওয়া বন্যা এবং শীতকালে পানির অপর্যাপ্ততা এতটা তীব্র হতো না।

একাডেমিক ফিল্ডে নিষ্কাশনব্যবস্থার মডেল যেমন ডেনড্রাইটিক, ট্রেলিস, রেডিয়াল বা আয়তক্ষেত্রাকার নিয়ে আলোচনা করার সময়, ‘জিয়া মডেল’ একটি অত্যন্ত সফল ও অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পায়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার ডেনড্রাইটিক নিষ্কাশনব্যবস্থা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খালের ট্রেলিস নিষ্কাশনব্যবস্থা কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে- এর বাস্তব প্রমাণ হিসেবে জিয়ার খাল খনন কর্মসূচি অতুলনীয় সাফল্যের সাক্ষী। এই মডেল শুধু পানি ব্যবস্থাপনায় নয়, গ্রামীণ উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তাতেও একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। বন্যা ও খরা প্রতিরোধে খাল ও নদীর খনন ও পুনঃখনন কর্মসূচি এখন সময়ের দাবি। এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে, কৃষিকাজে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং সুপেয় খাবারের পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি ‘জিয়া মডেল’ আবার জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে।

এই খাল খনন কর্মসূচি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল এবং এই সময়ে মোট ২৭৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার খাল খনন করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩ হাজার ৬৩৬ মাইল। এর মাধ্যমে লক্ষাধিক একর জমিকে সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এই কর্মসূচি চালু হয়, যা কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে খাল খনন করে বর্ষার পানি সংরক্ষণ, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন এবং খাদ্য স্বনির্ভরতা অর্জনে সহায়তা করেছিল। এই কর্মসূচির ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং গ্রামীণ স্বনির্ভরতা বাড়ে, যেখানে বিভিন্ন এলাকার মানুষ অংশগ্রহণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিবিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়। যদি এটি অব্যাহত থাকত, তবে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারত। তাই বর্তমান সরকারের উচিত হবে এই কর্মসূচি পুনরায় চালু করা।

আমরা আশা করব, ভবিষ্যৎ সরকার এটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করবে। এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের চরম ক্ষতি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে ফেনীর বন্যার দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার একটি প্রধান কারণ সেখানকার নিষ্কাশনব্যবস্থার ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এছাড়া দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলেও এর প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কৃষিকাজে সেচের জন্য বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের (বরেন্দ্র অঞ্চলের) খালগুলো শীতকালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিন্তু বর্তমানে খাল ও নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, এই অঞ্চলে পানির অভাব দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে, একই সঙ্গে বর্ষাকালে বন্যার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে পানি-নিরাপত্তা অনেক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ ঝুঁকির মাত্রা ১৯৮০ সালের দিকে ছিল মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, তা ২০২১ সালের গিয়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে এবং ২০২৬ সালে এটি ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশে দাঁড়াবে। যদি খালগুলো রক্ষা করা যেত, তবে এই সংকট এতটা তীব্র হতো না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, যা শীতকালে সাধারণ মানুষ হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ডিপ টিউবওয়েল বা শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। যেসব পরিবার তা করতে পারছে না, তারা অন্যদের থেকে পানি কিনে ব্যবহার করছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ওই অঞ্চলে যারা পানি কিনে ব্যবহার করছে, তাদের মাসিক গড় খরচ প্রায় ১ হাজার ৮০০ টাকা। এর ফলে পরিবারগুলোর আর্থিক চাপ বাড়ছে এবং তারা ক্রমেই দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যদি খালগুলো রক্ষিত থাকত, তবে ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্নবায়ন হতো এবং সহজেই পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা যেত। এ অঞ্চলে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে শুধু পানিসংকট নিরসন হতো না; বরং তা এসডিজি লক্ষ্যগুলোও যেমন এসডিজি ১, এসডিজি ৬, এসডিজি ১৩ ও এসডিজি ১৫ অর্জন করতে সহায়তা করত। মধ্যাঞ্চলের নদী, খাল ও প্লাবন ভূমি অতিরিক্ত বর্ষার পানি দ্রুত নিষ্কাশনে সাহায্য করত। একই সঙ্গে শীতকালে পানি ধরে রেখে সেচের সুবিধা নিশ্চিত করত। কিন্তু খালগুলোর ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে বর্তমানে বর্ষাকালে তীব্র বন্যা দেখা দেয় এবং শীতে পানির সংকট তৈরি হয়। এর ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে। ১৯৭০-এর দশক থেকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরের দিক থেকে সুপেয় পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এর ফলে ১৯৭০ থেকে ২০২০ মধ্যে প্রায় অতিরিক্ত ৪ লাখ হেক্টর জমিতে নতুন করে লবণাক্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে এ লবণাক্ততা ৫০-১০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রসারিত হয়, যা মাটির উর্বরতা ও পানির গুণমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে খাওয়ার পানি তীব্র সংকট সৃষ্টি ও কৃষিজমিতেও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় জিয়াউর রহমান খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদি কর্মসূচি চালু থাকত, তবে খালগুলো মিষ্টি পানি ধরে রাখতে সাহায্য করত এবং নদীগুলো সঠিকভাবে খনন হলে লবণাক্ততা এতটা বিস্তার লাভ করত না। খাল খননের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় মিঠাপানির সংরক্ষণ শুধু কৃষিতে নয়, মাছ চাষেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলত।

লেখক : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কনভেনর, সাদা দল, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত