প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২২ আগস্ট, ২০২৫
মানুষ মূলত সামাজিক প্রাণী। মানুষ একে-অন্যের সংস্পর্শে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু কোনো এক সময়ের পর মানুষ একাকিত্ব বেছে নেয় কিংবা সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একাকিত্ব এসে ভর করে মানুষের উপর। আর যখন একাকিত্ব এসে ভর করে তখন স্বাভাবিকভাবেই বিষন্নতার গভীর সাগরে ডুবে যায় মানুষ।
এতদিন ধারণা করা হতো বয়স্ক মানুষেরাই এমন নিঃসঙ্গতা রোগে বেশি ভোগে। কেননা, এত এত বছর পৃথিবীর বুকে বেঁচে থেকে, কোনো একটা সময় পর তাদের উপলব্ধি হয় এতদিন যাদের পাশে সে ছিল, তারা হয়তো তার আসল বন্ধু নয়। হয়তো, অনেকেই তাকে নিজ স্বার্থ হাসিল করার জন্য তাকে ব্যবহার করেছে। এবং যখন তারা এমন কিছু চিন্তা সেই মানুষের মাথায় এসে খেলা করতে থাকে তখন সে একাকিত্ব বেছে নেয়। নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে নিজস্ব এক ভুবন তৈরি করে যেখানে সে ছাড়া অন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না কিংবা সেই ব্যক্তি অন্য কাওকে সেই দুনিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দেয় না। যদিও সে ব্যক্তি মনে করে একাকিত্ব কিংবা নিঃসঙ্গতা তাকে সবার থেকে বাঁচিয়ে রাখছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা না। এটাকে বরং বলা যেতে পারে সুখের ছদ্মবেশী শত্রু।
অর্থ্যাৎ, যারা একাকিত্বে ভোগে তাদের মনে হয় যেন তাদের পরম সুহৃৎ কিন্তু আসলে একাকিত্ব হলো তাদের পরম শত্রু। একাকিত্ব মূলত তাকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে নিঃসন্দেহে। এটা আমার মুখের কথা না। এমনটাই জানা যাচ্ছে কিছু গবেষণার মাধ্যমে। সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি আপনাদের সামনে। করোনা মহামারিকালের পরেই ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) একাকিত্বকে বিশ্বব্যাপী জনগণের স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে জানিয়েছে এক রোমহষর্ক তথ্য। সেই তথ্যের মাধ্যমে জানতে পারা যায়, মাত্র ১ দিন একাকিত্বে ভোগার ফলে মস্তিষ্কে বিরাট ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ, সেই তথ্যানুযায়ী জানা যায় মাত্র ১ দিন একাকিত্বে ভুগলে তা দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়ার সমান! পাশাপাশি সেই গবেষণার মাধ্যমে আরও জানা যায়, অসামাজিক জীবনযাপনের ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে ২৯ শতাংশ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ৩২ শতাংশ। সেইসঙ্গে একাকিত্ব ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায় ৫০ শতাংশ। এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, যারা পরিবার ও সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখেন, তাদের উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, হ্যালুসিনেশন, প্যানিক অ্যাটাকের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগার হার অনেক বেশি বেড়ে যায়। করোনা মহামারিকালের পর থেকেই শারীরিক ও মানুষিক স্বাস্থ্যের উপর গবেষণার চালানো হচ্ছে। সেখানে দেখা গেছে, একাকিত্ব কিংবা নিঃসঙ্গতার ফলে মানুষের জীবনে ঢের প্রভাব ফেলে। এই গবেষণার মাধ্যমে তারা জানিয়েছে, উত্তর আমেরিকায় একাকিত্বে ভোগার হার সর্বোচ্চ, ১৫ শতাংশ। এদের বেশির ভাগের বয়স ষাটের উর্ধ্বে। আফ্রিকায় এই হার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, জরিপ অনুসারে, সবচেয়ে কম একাকিত্বে ভুগছে ইউরোপের মানুষ। তাদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। যেসব তরুণ কলেজজীবনে একাকিত্বে ভুগেছেন, তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যার কারণে, চাকরিজীবনেও তাদের খুব কমই সফলতার দেখা পান। এবার আসা যাক তরুণদের কাছে। বর্তমান সময়ে তরুণরাও একাকিত্বে ভুগছেন অস্বাভাবিক হলেও সত্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জন মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, যার একটি বড় অংশ হলো তরুণ প্রজন্ম। ২০১৯ সালে জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জেএএমএ) প্রকাশিত এক গবেষণাযর মাধ্যমে জানা যায়, দিনে ৭ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন ব্যবহারের ফলে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ফোরসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিনিধিত্বমূলক টেলিফোনিক জরিপের ভিত্তিতে জানা যায়, তরুণরা নিঃসঙ্গতায় বেশি ভোগেন। বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সিদের মধ্যে ৬৮% বলেছেন যে, তারা প্রায়ই, মাঝে মাঝে বা খুব কম হলেও নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব অনুভব করে থাকেন। এছাড়া এই বয়সের ৩৬% খুব অধিক বা বেশ গুরুতর চাপ হিসেবে অনুভব করে থাকেন। তুলনামূলকভাবে, ৪০ থেকে ৫৯ বছর এবং ৬০ বা তার বেশি বয়সি গোষ্ঠীর মধ্যে এই হার যথাক্রমে ১৯% থেকে ২১%। তরুণদের অধিক সময় ধরে মোবাইল ফোন কিংবা স্ক্রিনে ব্যয় করার ফলে তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতা অথবা সময় কাটানো থেকে বঞ্চিত হয়। এবং এর কারণে ধীরে ধীরে একাকিত্ব একাকিত্ব বরণ করে নেয়। অন্যদিকে, জার্মানি-ও একাকিত্বের হারের দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। সেই দেশের জনস্বাস্থ্য বিমা সংস্থা টেকনিকার ক্রাংকেনকাসে (টিকে)-এর বোর্ড চেয়ারম্যান জেন্স বাস বলেন, ‘নিঃসঙ্গতা শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এটি প্রমাণিত হয়েছে।’
নিঃসঙ্গতা কিংবা একাকিত্ব বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। অধিক কাজের চাপ, স্ক্রিনে ডুবে থাকা অথবা বেকারত্বসহ নানান কারণেই একাকিত্ব ভর করতে পারে ব্যক্তির উপর। তবে, এই একাকিত্ব কাটানোরও কিছু উপায় আছে। এই একাকিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকলে জীবন হয়ে উঠবে বিভীষিকাময় এবং পীড়াদায়ক। জীবনের প্রতিটি পদে দুর্ভোগ পোহাতে হবে নিজের সঙ্গে নিজের। একাকিত্ব হলো পোষা সাপের মতো। অর্থাৎ, সাপকে যেমন বছরের পর বছর নিজের সন্তানের মতো পালন করলেও হঠাৎ একদিন ছোবল মেরে দিতে পারে; ঠিক তেমনই একাকিত্বকে দীর্ঘদিন ধরে লালন করলে কোনো একদিন আমাদের অগোচরেই আমাদের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। আপনাদের আশপাশে কিংবা আপনারা একাকিত্বে ভুগে থাকলে অবশ্যই নিজের পছন্দের কাজগুলো করবেন, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাবেন, পাড়া-প্রতিবেশিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখুন, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। যদি এগুলো অথবা অন্য কোনো কিছু করে মানুষের সঙ্গে সময় ব্যয় করে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারি তাহলে একাকিত্ব থেকে রক্ষা পাবো আমরা।
এনআইএইচণ্ডএর গবেষণাকালে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একা থাকা আর একাকিত্বে ভোগা দুটি আলাদা বিষয়। একা থাকা সমস্যা নয়, বরং একাকিত্বে ভোগা ঝুঁকিপূর্ণ। একা থেকে আপনি যদি সময়টা উপভোগ করেন, সৃজনশীল কাজে ব্যয় করেন, বই, প্রকৃতি, পোষা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটান, স্বাস্থ্যকর জীবন কাটান, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ থেকে বিরতি নিয়ে পেছনে ফিরে তাকান বা ‘রিফ্লেক্ট করেন’, জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকেন, নিজের সত্যিকারের স্বাধীনতা উপভোগ করেন, তাহলে তা বরং আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
অর্থাৎ, আমরা একা থাকতেই পারি তবে একাকিত্বকে যেন আলিঙ্গন না করে ফেলি সেদিকে সতর্ক থাকবো। কারণ, একাকিত্ব কখনোই সুফল নিয়ে আসে না বরং একাকিত্ব একজন মানুষের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় আনতে যথেষ্ট। সুতরাং, আপনাদের সবার কাছে অনুরোধ করব আপনারা যেনো আপনাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অথবা পাড়া-প্রতিবেশিদের সঙ্গে সময় কাটান এবং তারা এই নিঃসঙ্গতা নামক ব্যধিতে ভুগলে তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করুন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সংস্পর্শে থেকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন