প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২২ আগস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচির বিস্তার, অপুষ্টি মোকাবিলায় উন্নতি- এসব ক্ষেত্রেই দেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে একটি মৌলিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। আর সেটি হলো নবজাতক ও শিশুদের মাতৃদুগ্ধ গ্রহণ। মাতৃদুগ্ধ শুধু একটি খাদ্য নয়, বরং শিশুর জীবনের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও সামাজিক সুরক্ষার ভিত্তিস্থাপন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফের মতে, জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত এবং দুই বছর বা তারও বেশি সময় অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি স্তন্যপান অব্যাহত রাখা উচিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এই মানদ- পূরণে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান : বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-এর তথ্য অনুযায়ী: ২০১১ সালে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মাতৃদুগ্ধ পেত প্রায় ৬৪ শতাংশ শিশু। ২০২২ সালে এ হার নেমে এসেছে মাত্র ৫৫ শতাংশে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে জন্মের প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পাচ্ছে মাত্র ৪৯ শতাংশ শিশু। অর্থাৎ দেশের অর্ধেকেরও বেশি শিশু জন্মের পরপরই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক দশকে প্রায় ৯ শতাংশ পতন নিছক পরিসংখ্যান নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ সংকেত।
কেন কমছে মাতৃদুগ্ধ পান? এই হ্রাসের পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. শিশুখাদ্য শিল্পের আগ্রাসী বিপণন, শিশুখাদ্য বা ফর্মুলা মিল্কের রঙিন বিজ্ঞাপন টেলিভিশন, ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সুপারশপে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘শিশু আরও শক্তিশালী হবে’, ‘বুদ্ধিমত্তা বাড়বে’, কিংবা ‘দুধের বিকল্প’। কিন্তু এগুলো বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো ফর্মুলা দুধই মাতৃদুগ্ধের সমতুল্য নয়। অথচ অসংখ্য মা এসব বিজ্ঞাপনের প্রভাবে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন বা সীমিত করেন।
মাতৃত্বকালীন ছুটির সীমাবদ্ধতা : সরকারি খাতে ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও বেসরকারি খাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিন-চার মাসের বেশি ছুটি দেওয়া হয় না। ফলে মায়েদের কর্মস্থলে ফেরার আগেই শিশুকে বিকল্প খাদ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেক কর্মস্থলে স্তন্যপানের জন্য আলাদা জায়গা নেই, ফলে কর্মজীবী মায়েরা দুধ খাওয়ানো অব্যাহত রাখতে পারেন না।
স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি ও তথ্যের অভাব : বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা এখনো পর্যাপ্ত নয়। প্রসূতি মা ও পরিবারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার মতো স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় বহু মা জানেন না যে জন্মের পর প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো কতটা জরুরি। এ ছাড়া অনেক হাসপাতাল বা ক্লিনিকে জন্মের পর শিশুকে সরাসরি মায়ের কাছে দেওয়া হয় না, ফলে দুধ খাওয়ানোর সুযোগ বিলম্বিত হয়।
সামাজিক কুসংস্কার ও পারিবারিক চাপ : গ্রামীণ ও শহুরে সমাজে এখনও নানা কুসংস্কার প্রচলিত। যেমন- প্রথম দুধ (কলস্ট্রাম) শিশুকে না খাওয়ানো, জন্মের পরপরই শিশুকে মধু বা মিষ্টি পানি খাওয়ানো, কিংবা দাদি-নানির চাপে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো। এসব অভ্যাস শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।
মাতৃদুগ্ধ না পেলে শিশুর ক্ষতি : মায়ের দুধ বঞ্চিত শিশুরা শুধু তাৎক্ষণিক অপুষ্টির শিকার হয় না, বরং আজীবন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হয়।
শারীরিক সমস্যা : অপুষ্টি ও খর্বাকৃতি: মাতৃদুগ্ধে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিবডি। এগুলো না পেলে শিশুর উচ্চতা-ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, খর্বাকৃতি হয়ে যায়।
ঘন ঘন রোগবালাই : স্তন্যপানকারী শিশু ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানের ইনফেকশন ও সর্দি-কাশি থেকে সুরক্ষা পায়। বুকের দুধ না পাওয়া শিশুরা বারবার এসব রোগে ভোগে।
মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি : গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের প্রথম ঘণ্টায় দুধ না পেলে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। ছয় মাস একচেটিয়া স্তন্যপান না করলে মৃত্যুর সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।
স্থূলতা ও ডায়াবেটিস : গবেষণা প্রমাণ করে, স্তন্যপান বঞ্চিত শিশুরা পরবর্তী জীবনে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা : মস্তিষ্কের বিকাশে ঘাটতি: মাতৃদুগ্ধে থাকা ডিএইচএ ও এআরএ শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের বিকাশে অপরিহার্য। এগুলো না পেলে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হয়। শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে পড়া: একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, স্তন্যপান বঞ্চিত শিশুরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না এবং শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে পড়ে।
মানসিক ও সামাজিক সমস্যা : মা-শিশুর বন্ধন দুর্বল হওয়া: স্তন্যপান মা ও শিশুর মধ্যে আবেগপূর্ণ বন্ধন সৃষ্টি করে। এটি না হলে শিশুর নিরাপত্তাবোধ ও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দেয়।
আত্মবিশ্বাসহীনতা : ছোটবেলা থেকেই শিশুর মনে নিরাপত্তাহীনতা জন্ম নেয়, যা ভবিষ্যতে তার সামাজিক আচরণ ও আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে।
লেখক পরিচিতি : কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা