ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বেপরোয়া যান, গিলে খাচ্ছে প্রাণ

সাকী মাহবুব
বেপরোয়া যান, গিলে খাচ্ছে প্রাণ

আমরা প্রতিদিনই ঘর থেকে বের হই জীবিকার তাগিদে, শিক্ষা-চিকিৎসা কিংবা প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু অনেকেই আর বাড়ি ফেরেন না- পথের মাঝে কোনো বেপরোয়া যান কেড়ে নেয় তাদের জীবন। সড়কে যেন মৃত্যুর ফাঁদ পাতা! গাড়ির গতি, চালকের অসচেতনতা, আইন না মানা আর খোঁড়া অবকাঠামো- সব মিলিয়ে সড়কগুলো হয়ে উঠছে মৃত্যুপুরী। সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে এই ট্র্যাজেডির মাত্রা বোঝা যায়: বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের (জানুয়ারি-জুন) সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে বলা হয় : সারা দেশে ৩,৮৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪,৬৪২ জন। আহত হয়েছেন ৫,৫৪৯ জন। গড় হিসাবে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে প্রায় ২৬ জন মানুষ।

প্রতি বছর বিশ্বে ১৩ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ দুর্বল। গতি নিয়ন্ত্রণে না রাখা, ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ড্রাইভিং- এসবই মরণফাঁদ।

অনেক চালক সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাস্তায় গাড়ি চালান। ট্রাফিক আইন জানা তো দূরের কথা, অনেকের নকল লাইসেন্স থাকে। ভাঙা রাস্তা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, সংকীর্ণ ফুটপাত, ড্রাইভার-হেলপারের মধ্যে অসঙ্গতি- সবই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। যাত্রীদের চলাফেরায় নিয়ম না মানা, যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া, ট্রাফিক আইন অমান্য করাও বড় কারণ। যথাযথভাবে আইন না মানানো, জরিমানা বা শাস্তি না হওয়া চালকদের বেপরোয়া হতে উৎসাহ দেয়। ঢাকার এক অফিসগামী তরুণী, নিশাত। প্রতিদিন বাসে করেই অফিসে যেতেন। ২০২৫ সালের মে মাসে বাস থেকে নামতে গিয়ে পেছনের আরেকটি বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন তিনি। তার ছোট ভাই আজও চোখের জল ফেলে প্রশ্ন করে- ‘আমার বোন কি ভুল করেছিল শুধু বাসে চড়েই?’ এসব বিপর্যয়ের প্রভাবের ফলে দুর্ঘটনায় শুধু প্রাণহানি নয়, পঙ্গুত্ববরণকারীদের চিকিৎসা, পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও জাতীয় অর্থনীতিতে বিপুল ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনার শিকার ও তাদের স্বজনরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, অনেকে বছরের পর বছর ট্রমা থেকে বের হতে পারেন না। সমাধান কোনপথে? আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সড়ক সংস্কার, স্পিড ব্রেকার ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন জরুরি। ফিটনেসবিহীন যান ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে। নিয়ম ভাঙলেই কঠিন জরিমানা, ড্রাইভিং নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বাস্তবায়ন জরুরি।

স্কুল-কলেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালানো উচিত। যাতে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন এড়িয়ে নিরাপদ ভ্রমণ করতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি সংবাদ শিরোনাম নয়; প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে আছে একটি পরিবারের ধ্বংস, স্বপ্নের চুরমার হওয়া। আর কত প্রাণ যাবে? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? সময় এসেছে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার, সচেতনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের। বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ না হলে, আমাদের ভবিষ্যৎও থেমে যাবে মৃত্যুর স্রোতে।

লেখক : সহকারী শিক্ষক নাদির হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত