ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আরাকানের শিল্প ও সংস্কৃতি

আসাদুল করিম
আরাকানের শিল্প ও সংস্কৃতি

শিল্পকলার মতো সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিজ্ঞানের একটি গতিময় অথচ বিমূর্ত বিষয়। মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগেও শিল্প-সংস্কৃতিক্রমশ পূর্ণাঙ্গরূপে বিকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে সময়ের গতিময়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘শিল্পকলা’ ও ‘সংস্কৃতি’ শব্দের প্রয়োগ যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যাপক হারে এগুলোর চর্চাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এ কথাও সত্য যে, বাহ্যিকভাবে সংস্কৃতিও শিল্পকলার বিকাশ পথে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন পরিলক্ষিত হলেও মৌলিক ও উদ্ভবগত দিক থেকে সেগুলো নিজস্ব উৎসকেই ধারন করে আছে। কেননা, মৌলিক বিশ্বাস ও রুচিবোধ থেকেই জন্ম হয় সংস্কৃতি, আর সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই গড়ে ওঠে শিল্পকলা। তাই বলা যায়, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা শব্দ দুটি একই ঘরানায় অবস্থান করলেও সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, কারুকার্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি সংস্কৃতি নয় বরং শিল্পকলা। মূলত শিল্পকলাই হল সংস্কৃতির বাহন।

সুতরাং সংস্কৃতির জন্ম বিশ্বাসে আর বিকাশ শিল্পকলার মাধ্যমে। এ দিক বিবেচনায় পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল, তাকে বাস্তবে রূপ দিতেই শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছে। সেই সূচনাকাল থেকে সময়ের ধারাবাহিকতায় একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যেমন বৈচিত্র্যময় বোধ বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, তেমনি হাজারো রকমে গঠিত হচ্ছে সংস্কৃতির অয়বর; আর সংস্কৃতির এ নবগঠিত অবয়বকে অবলম্বন করেই বিকশিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্পকলা। এ কারণে শিল্পকলা ও সংস্কৃতি শব্দের সঙ্গে আরও নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও আকার ধারণ করেছে, যেমন- মুসলিম সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, হিন্দু সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, জড়বাদী সংস্কৃতি ও শিল্পকলা প্রভৃতি। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো আরাকানের ইতিহাসেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। অত্র অধ্যায়ে সেখানকার স্থানীয় শিল্পকলা ও সংস্কৃতির মধ্যে মুসলিম শিল্পকলা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস চালানো হয়েছে।

আরাকানের শিল্পকলা ও সংস্কৃতি : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত : প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের স্বাধীন ভূখণ্ড আরাকান সাংস্কৃতিক এতিহ্যমণ্ডিত একটি অঞ্চল। দীর্ঘ সময়ের আবর্তনে এখানে যেমন নতুন নতুন বিশ্বাস ও ধর্মের উদ্ভব হয়েছে, তেমনি সেই আলোকেই গড়ে উঠেছে নতুন নতুন সাংস্কৃতিক বলয় এবং শিল্পকলার নানাবিধ আকর্ষণীয় মডেল। খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সেখানে মৌলিকভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সংস্কৃতির অভ্যুদয় ঘটে। জড়বাদী সংস্কৃতির লালন করে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দে মারুবংশীয় রাজাগণ আরাকান শাসন শুরু করলেও ভারতীয় সভ্যতার ছোঁয়ায় তারা ক্রমশ হিন্দু ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। কেননা, খ্রিষ্টপূর্ব থেকেই ভারত ছিল, বর্তমান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে শিক্ষাসংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। ফলে এ অঞ্চল থেকে শুধু আরাকান নয় বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়-জাভা প্রভৃতি অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল। এমনকি আরাকান অঞ্চলসহ আধুনিক মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয় ও ইন্দ্রোনেশিয়াকে ‘ভারতীয়কৃত’ অঞ্চল নামে অভিহিত করা হতো। অনেক সময় এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুকরণকৃত রাজ্য’ ও বলা হতো।

ভারতীয় হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির ফলে সেখানে বহু রকমের মূর্তিপূজা, বৃক্ষপূজা, সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্র পূজার মাধ্যমে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের নিমিত্তে বিভিন্ন ধরনের বেদী, মন্দির, মূর্তি প্রভৃতি তৈরি করত। মারুবংশীয় রাজা অভিরাজের দুই পুত্র কানরাজগজী ও কানরাঞ্জির মধ্যকার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সমাধানে তারা চুক্তিবদ্ধ হয় যে, যে ব্যক্তি এক রাত্রির মধ্যে একটি ‘ধর্ম মন্দির’ নির্মাণ করে দিতে পারবে, সেই রাজা হবে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুচতুর কানরাঞ্জি কৌশলে এক রাত্রির মধ্যে মন্দির নির্মাণ করে দিয়ে আরাকানের রাজা হন। এভাবে প্রায় সাড়ে চারহাজার বছর অগেই জড়বাদী সংস্কৃতির প্রভাবে সেখানে ‘ধর্ম মন্দির’ নির্মিত হয়। কিন্তু তৎকালীন সময়ের উপাসনা পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। বৈদিক যুগ অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের পর থেকে মুলত হিন্দু ধর্মের সূচনা। এ সময় আর্য হিন্দুগণ সর্বপ্রথম বৈদিক ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমণ করে। তখন তারা ভূমি, আকাশ, পর্বত, নদী, উদ্ভিদ ইত্যদিকে পূজনীয় জ্ঞান করত। সেইসঙ্গে ঘোড়া, গাভী, পাখি অন্যান্য জীবজন্তু এমনকি মানুষের তৈরি বস্তুসামগ্রীকেও পূজা করত। অতঃপর খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৫০০ অব্দের মধ্যে সেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি চালু হয়। এ সময় দেবতার পূজা পার্বনের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণগণ একক নেতৃত্বে আসীন হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। অচিরেই এ শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব ও সভ্যতার ধারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে সীমান্ত গত যোগাযোগ থাকায় এখনকার প্রভাব সহযেই আরাকান অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক কপিলাবস্তুর যুবরাজ গৌতমবুদ্ধ কর্তৃক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পায়। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে অর্থাৎ ১৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মগধ থেকে আগত বৌদ্ধ সৈন্যরা আরাকান-চট্টগ্রাম অভিযানকালে এখানে ব্যাপকভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যেই আরাকান অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রবল হয়ে ওঠে। এমনকি গৌতম বুদ্ধের তিরোধানের পর খ্রিষ্টীয় ষষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত ভারত বর্ষেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ব্যাপক ছিল। কিস্তু সপ্তম শতাব্দির পর হতে নানাবিধ কুসংস্কার ও জাদুমন্ত্রের মিশ্রনের কারণে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব নিম্নগামী হতে থাকে। অন্যদিকে সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীলংকা, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওস অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ফলে ইসলাম আগমনের পূর্ব পর্যন্ত আরাকানে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চল হয়ে পড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সংস্কৃতির লালনকেন্দ্র।

মগধ থেকে এসে ১৪৬ সালে আরাকানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন চন্দ্র সূর্য (sandathur’ya-146-198) নামক জনৈক বৌদ্ধ সামন্ত। তিনিই আরাকানের ধন্যাবতীতে রাজধানী স্থাপন করে সেখানে চন্দ্রসূর্য বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আরাকানে এসে সেখানকার অধিবাসিদের অনুন্নত, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও জড়োপাসক অবস্থায় পান এবং তারই প্রচেষ্টায় অনুন্নত আরাকানীদের মধ্যে প্রথম ভারতীয় ভাষা, লিপি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি শিক্ষার সুযোগ হয়। এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, ১৪৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে ‘কনরাজগজী’ বংশের শাসকগণ জনগণের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ না ঘটিয়ে বরং লৌকিক প্রথার মাধ্যমে জড়োপসনা ও পূজা অর্চনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছেন। তবে খ্রিষ্টপূর্ব অস্টম শতাব্দী থেকে যেহেতু সেখানে ব্রাহ্মণ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং শাসক শ্রেণির মধ্যে হয়তো শিক্ষার চর্চা হতো। যাই হোক, তাদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য সেখানে ‘মন্দির’ নির্মাণ হয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আরাকানের চন্দ্র সূর্য বংশের রাজা সান্দা থুরিয়ে প্রথম বৌদ্ধ ধর্মকে রাজকীয় ধর্মরূপে ঘোষণা করেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের লক্ষ্যে রাজধানী ধান্যবতীতে ‘মহামুনি প্যগোডা নির্মাণ’ করে তাতে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি তৈরী করে বৌদ্ধদের উপসনার ব্যবস্থা করেন। অবশ্য এ সময়ও শাসকগণ হিন্দু ধর্মের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আরাকানের আকিয়াব অঞ্চলের আলেজাওয়া (Alezeywa) গ্রামে অবস্থিত শোয়েডাং প্যাগোডার অর্ধ মাইল উত্তরে ওয়ানতিতাং (wuntitang) নামক পাথর আচ্ছাদিত একটি পাহাড় আছে। উক্ত পাহাড়ে ওয়ানতিচেতি (wunticeti) নামক একটি প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এটি চন্দ্র সূর্য বংশের শাসনামলের প্রথমদিকে অর্থাৎ মহামুনি প্যাগাডো নির্মাণের প্রায় সমসাময়িককালে নির্মিত বলে অনুমান করা হয়।

এ মন্দিরে নারী-পুরুষ ও পশুর প্রতিকৃতিতে হিন্দু দেবদেবীর বেশ কিছু ছোট ছোট মূর্তি আছে। মূর্তিগুলোর নিকটে বর্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি প্রাচীন শিলালিপি দেখা যায়। কিন্তু শিলালিপির অক্ষরগুলো আংশিক মুছে গিয়ে দুষ্পাঠ্য হলেও অনুমান করা যায় যে, ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দে ম্্রথুখউর নামক জনৈক ব্যক্তি মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় য়ে, চন্দ্রসূর্য বংশের রাজাগণ বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তনকারী হলেও স্থানীয় হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে পুরোপুরি ভুলতে পারেনি। এমনকি ষোড়শ শতাব্দিতে আরাকানে বৌদ্ধ ও মুসলিম প্রভাবিত প্রশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলেও হিন্দু সংস্কৃতির অস্তিত্ব তখনও বিদ্যমান ছিল। সপ্তম শতাব্দিতেও বৈশালীর চন্দ্ররাজবংশের বাজাগণ বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে সহায়তা করেন এবং আনন্দ চন্দ্র, আনন্দোয়, আনন্দ মাধব, আনন্দেশ্বর প্রভৃতি নামে বহু মঠ, মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বৌদ্ধ ভীক্ষুদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দিয়ে তুষ্ঠ রেখে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের সহায়তা করেন। অনুরূপভাবে বৈশালীর চন্দ্র রাজরংশের রাজা বীরচন্দ্র (৫৭৫-৫৭৮ খ্রি.) বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারও পুণ্য অর্জনের নিমিত্তে একশতটি বৌদ্ধ স্তম্ভও নির্মাণ করেছিলেন।

সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় যে, খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে শুরু করে একাদশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত আরাকানের মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ফলে হিন্দু সংস্কৃতির ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে বৌদ্ধবাদ সংস্কৃতি এবং সেই ভিত্তিতেই বৌদ্ধ মন্দির, বিহার ও মঠ জাতীয় বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য-শিল্পকলার বিকাশ।

একাদশ শতাব্দীর শেষ পর্বে আরাকনের মহাযান বৌদ্ধ মতবাদের পাশাপাশি হিনযান বা থেরবাদ বৌদ্ধ মতের প্রচার শুরু হয়। ১০৫৬ খ্রিস্টাব্দে বার্মার থেটন রাজ্যের জনৈক শিন আরহন (Shin Arahan) নামক একজন বৌদ্ধ ধর্মগুরু পঁগা রাজ্যে আগমন করে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বার্মা থেকে মহাযান মতবাদ উচ্ছেদ করে প্রথম হিনযান মতবাদ প্রচার করেন। এ সময় ১০৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২৮৩ পর্যন্ত আরাকান অঞ্চল পঁগা রাজ্যের আওতাভুক্ত থাকায় আরাকানে হিনযান বৌদ্ধ মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাচীনকালের মারু রাজবংশীয় রাজারা নিজেদের প্রয়োজনে শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করত। এ ধারায় পরবর্তীকালে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ, উচ্চবর্ণ ও বিত্তশালীদের মধ্যেই লেখাপড়াকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু বৌদ্ধদের জ্ঞান চর্চা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্ম মন্দির, কেয়াং, মঠ, বিহার প্রভৃতির সঙ্গে বৌদ্ধদের শিক্ষাব্যাবস্থাও যুক্ত ছিল। কেয়াংয়ের ভিক্ষুরা বৌদ্ধ ছেলেমেয়েদের প্রথমিক তথা ধর্মীয় শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করতেন। স্থানীয় বৌদ্ধ অধিবাসীরা পালক্রমে দিনের মধ্যাহ্নে একবার ভীক্ষুদের খাবার সরবরাহ করত। এভাবে খুব দ্রুত জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার আলো সম্প্রসারিত হয় এবং সাধারণ লোকজন হিন্দুদের চেয়ে বৌদ্ধদের উদার প্রকৃতিতে দেখে বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে।

হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে পর্দা প্রথা ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যে শামিল নয়। তাই পোশাক পরিচ্ছেদে ব্রাহ্মণ কিংবা ভীক্ষু ছাড়া অন্য কোন হিন্দু-বৌদ্ধদের মধ্যে নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি ছিল না। তবে ব্রাহ্মণদের পৈতা কিংবা ভিক্ষুদের নির্দিষ্ট গেরুয়া পোশাক ও মাথা মুন্ডন তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। খাওয়া ও পান করার ব্যাপারে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে তেমন, কোন ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছিল না। তাই তারা সব ধরনের মাছ মাংস ভক্ষণ করত। এমনকি মদসহ যেকোনো পানীয় গ্রহণে ধর্মীয়ভাবে তেমন কোন বিধিনিষেধ ছিল না। তবে হিন্দুরা ‘দেবতা’ জ্ঞান করে গরুর গোশত ভক্ষণ করত না।

পঞ্চদশ শতাব্দির চল্লিশের দশকে নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ কর্তৃক ম্রাউক উ রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরাকানী সংস্কৃতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে ইসলামের আদর্শকে গ্রহণ করলে বৌদ্ধদের মধ্যে সে প্রভাব পড়ে। মুসলমানদের উদরতা ও ধর্মীয় মহানুভবতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেক বৌদ্ধই ইসলাম গ্রহণ করেছে আর কেউবা ইসলামের সামাজিক রীতিনীতিকে গ্রহণ করেছে। ফলে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্মারাজ বোধাপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমান ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ পরিবেশ বজায় থাকে। মোটকথা জড়োপাসক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদ অপরদিকে বৌদ্ধ ও মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবার সুবাদে আরাকানী শিল্পকলাতেও ধর্মমন্দির, বেদী, দেবমন্দির, মঠ, বিহার, কেয়াং, মসজিদ প্রভৃতি স্থাপত্য শিল্পকলার আবির্ভাব ঘটেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত