প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৬ আগস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশির দশকে আমদানিনির্ভরতা থেকে শুরু করে বর্তমানে দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন- এ খাতের বিকাশ নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ সাফল্যগাথা। বর্তমানে খাতটিতে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান, প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার দেশীয় বাজার রয়েছে এবং ২০২৪ সালে ওষুধ রপ্তানি আয়ে এসেছে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এ অর্জনের পেছনে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস ছাড়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বাংলাদেশকে পেটেন্টকৃত ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ কম খরচে উৎপাদনের সুযোগ দিয়েছে। তবে এ সাফল্য এবার এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটালে ট্রিপস ছাড়সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে- বিশেষ করে নতুন ওষুধ এবং এখনও পেটেন্ট সুরক্ষাধীন রয়েছে সেসব ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে, যেগুলো এতদিন এ ছাড়ের আওতায় ছিল। এর ফলে দেশে অনেক প্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন ও সুলভমূল্যে প্রাপ্তি ব্যাহত হতে পারে এবং রপ্তানির সুযোগও সীমিত হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া, সরকারি জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি, যেগুলো মূলত সস্তা জেনেরিক ওষুধের ওপর নির্ভরশীল, তা ব্যাহত হতে পারে।
এলডিসি-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে কঠোর আন্তর্জাতিক মান মেনে চলতে হবে। একই সময়ে বিশ্বব্যাপী জেনেরিক ও বায়োলজিক ওষুধ বাজারে প্রতিষ্ঠিত এবং নবাগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা- বিশেষত বায়োটেকনোলজি, অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট উৎপাদন এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অবকাঠামোর ঘাটতি- বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলবে।
এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে শুধু জেনেরিক উৎপাদননির্ভর মডেল থেকে বের হয়ে এসে উদ্ভাবন, গুণমান নিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক সংহতকরণে মনোযোগ দিতে হবে। এ রূপান্তর ঘটাতে শিল্পের সঙ্গে একাডেমিয়ার ঘনিষ্ঠ, কৌশলগত সহযোগিতা অপরিহার্য। এটি এখন আর কোনো বিকল্প নয়; বরং একটি অপরিহার্য চাহিদা। তবে বাংলাদেশে একাডেমিক গবেষণা দীর্ঘদিন ধরেই শিল্পের বাস্তব চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। দীর্ঘস্থায়ী অর্থায়ন-ঘাটতি, পরীক্ষাগারের পুরোনো পরিকাঠামো, পুরোনো ও যুগোপযোগিতা বিবর্জিত সিলেবাসের ওপর নির্ভরশীল পাঠদান প্রথা এবং বেসরকারি খাতের সীমিত সম্পৃক্ততার কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবনের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারেনি। শিক্ষা খাতে গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটও অপ্রতুল। ফলে ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে একাডেমিয়া ও শিল্পের মধ্যকার দূরত্ব বহুমাত্রিক।
একাডেমিক পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো গবেষণার তাত্ত্বিকপ্রবণতা, যা শিল্পের প্রয়োগমুখী চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়; এ ছাড়া শিল্প-সহযোগিতা কার্যকর করার জন্য টেকনোলজি ট্রান্সফার অফিস কিংবা ইন্ডাস্ট্রি লিয়াজোঁ ইউনিটের মতো কাঠামোগত সুবিধার অনুপস্থিতি রয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োগমুখী গবেষণার জন্য অর্থায়নের ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব এবং বায়োটেকনোলজি, রেগুলেটরি সায়েন্স ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব সমস্যা আরও ঘনীভূত করে।
অন্যদিকে, শিল্পের দিক থেকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উদ্ভাবন ও গবেষণার প্রতি সীমিত মনোযোগ, একাডেমিক অংশীদারত্বে বিনিয়োগে অনীহা এবং কাঠামোগত সহযোগিতার অভাব—এসব কারণে অনেক কোম্পানি স্বল্পমেয়াদি লাভকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা অবহেলা করে। ফলে পাঠক্রম উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং যৌথ গবেষণায় শিল্পের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। পারস্পরিক অবিশ্বাস, মেধাস্বত্ব নিয়ে উদ্বেগ এবং উচ্চস্তরের বৈজ্ঞানিক দক্ষতার দুর্বল চাহিদা—এ সহযোগিতাকে আরও দুর্বল করে তোলে। এ দূরত্ব ঘোচাতে একটি সমন্বিত জাতীয় কৌশলের অভাবও স্পষ্ট।
এ প্রেক্ষাপটে ফার্মাসিউটিক্যাল উদ্ভাবনে গতি আনতে যৌথ গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি ও পরিকল্পিত বিনিয়োগের প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের চারটি বিভাগ, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিকস এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ শিল্প-নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে নতুন বায়োসিমিলার এবং উদ্ভাবনী ওষুধ প্রস্তুত করতে পারে। একাডেমিক প্রাঙ্গণে শিল্প-সমর্থিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করলে বিদেশি ল্যাবনির্ভরতা কমবে, ব্যয় হ্রাস পাবে এবং বাজারে প্রবেশের সময় দ্রুত হবে। গবেষণাকাজে পারদর্শী শিক্ষকদের পারফরম্যান্সভিত্তিক অনুদানের মাধ্যমে শিল্পপ্রাসঙ্গিক গবেষণায় উৎসাহিত করা যেতে পারে। ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৫ শতাংশ শিল্পনেতা মনে করেন যে, স্নাতকদের দক্ষতা শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শিল্পের পরামর্শ অনুযায়ী নতুনভাবে সাজাতে হবে, যেখানে রেগুলেটরি সায়েন্স, বায়োইকুইভ্যালেন্স, জিএমপি মান, ডেটা অ্যানালাইটিকস ও আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব থাকবে। ইন্টার্নশিপ ও কো-অপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেওয়া এবং শিল্প-একাডেমিয়া শিক্ষক বিনিময় কার্যক্রম চালু করা সময়োপযোগী হবে।