ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্ক

ফারহানা মান্নান
পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্ক

আমরা যখন দিনশেষে বাড়ি ফিরি, তখন পরিবারের বুকে মাথা রেখেই দিনের সব ক্লান্তি ভুলে যাই, না পাওয়া বা কষ্টে পাওয়া বা হারানো সবকিছুর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কোনো সমাধান নয় বরং আস্থার কিছু বাণী, পরদিনের জটিল জীবিকায় ফিরতে সহযোগী হয়ে পাশে দাঁড়ায়। আমরা অনেকেই এই সত্য অনুধাবন করি ঠিক; কিন্তু কতজন যথার্থ মূল্যায়ন করি?

পারিবারিক সম্পর্কের পাশাপাশি সমাজে বিদ্যমান নানা রকমের সম্পর্কগুলো নিয়ে আমরা এখন কোন অবস্থানে আছি? আমরা কে, কতটা মানুষের মতো আচরণ করছি বা পাচ্ছি? সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব ও বন্ধন দুর্বল হওয়ার জায়গায় আমরা নানা প্রশ্ন করতে পারি। প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে পারি। এগুলো সরাসরি সমাধানের পথ দেখিয়ে না দিলেও চিন্তার জায়গায় কিছু আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই ভাবতে পারি এই পাঁচটি প্রশ্ন নিয়ে। আধুনিক সমাজে কি সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে? সামাজিক বন্ধন নিয়ে যদি ভাবি তাহলে বলা যায়, সামাজিক বন্ধন বলতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগকে বোঝায় যা একে অপরের মধ্যকার আস্থা, সহযোগিতা ও সামাজিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করে। যদি অন্যভাবে চিন্তা করি, সামাজিক বন্ধন মানুষের সঙ্গে মানুষের মধ্যকার বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ও সহযোগিতার গল্প বলে। আধুনিক সমাজে দ্রুত নগরায়ন, ডিজিটালাইজেশন এবং বৈশ্বিকীকরণ এই বন্ধনগুলোর প্রকৃতি এবং দৃঢ়তা পরিবর্তন করছে।

পরিবর্তন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই হচ্ছে। প্রথমে নগরায়ন নিয়ে চিন্তা করি। ১৯৯৭ সালের একটি গবেষণায় স্যামসন এবং তার সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে, দৃঢ় সামাজিক বন্ধন অপরাধ এবং সহিংসতা কমাতে সাহায্য করে, যেখানে দ্রুত নগরায়ন প্রতিবেশী সম্পর্ককে দুর্বল করে। দুর্বল সামাজিক অংশগ্রহণ একাকিত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দৃঢ় সামাজিক বন্ধন উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং একাকিত্বের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। সামাজিক বন্ধন নিয়ে যদি ভাবি তাহলে বলা যায়, সামাজিক বন্ধন বলতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগকে বোঝায়, যা একে অপরের মধ্যকার আস্থা, সহযোগিতা ও সামাজিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করে।

২০২৫ সালে, গ্লোবাল সোশ্যাল ট্রেন্ড কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শারীরিক সামাজিক মেলামেশার সময় প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যদিও অনলাইন সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সংযোগের সংখ্যা বাড়ায়, কিন্তু প্রায়ই গভীরতা এবং আবেগগত অন্তর্ভুক্তি কমিয়ে দেয়। ২০০৩ সালে নোরিস উল্লেখ করেছেন যে, বৈশ্বিক সামাজিক বন্ধন সহিষ্ণুতা ও নাগরিক অংশগ্রহণকে সমর্থন করতে পারে; কিন্তু এটি স্থানীয় সামাজিক বন্ধনকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে।

এক কথায় আধুনিক সমাজে তা বেড়েছে না কমেছে তা বলা যাচ্ছে কি? তবে সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাল্যান্সের অভাব স্পষ্ট! সমস্যা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। সাদা চোখে দৃঢ় সামাজিক বন্ধনের অভাব মানবিক আচরণের ক্ষেত্রে কি বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? শৈশবে বাবা-মা, শিক্ষক ও বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন কীভাবে নৈতিক বিকাশকে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে?

শৈশবে বাবা-মায়ের সঙ্গে চমৎকার সহানুভূতিশীল সম্পর্ক শিশুদের নৈতিক জ্ঞানের ভিত্তি মজবুত করে। ২০০২ সালে কোনান্সকা মন্তব্য করেন, যেসব শিশুদের সঙ্গে বাবা-মা দৃঢ় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখেন তারা সহানুভূতিশীল, সৎ এবং নিয়ম মেনে চলতে আগ্রহী হয় পরবর্তী জীবনে। ১৯৯১ সালের একটি গবেষণায় ওয়েন্টজেল উল্লেখ করেছেন, শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং ন্যায্য আচরণ করেন, সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিষ্ঠা, সহযোগিতা এবং নৈতিক আচরণের প্রবণতা বেশি থাকে। ভালো বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। আধুনিক সময়ে টেলিভিশনে বিগ ব্যাং থিওরি নামে একটা সিরিজ হয়েছে এবং বেশ সাড়া ফেলেছেও! একজনের নাম শেলডন। সে বিজ্ঞানী এবং তার মধ্যে অটিজম স্পষ্ট। সে ঠাট্টা বোঝে না। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে ভীষণ রকমের দুর্বল। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে বছরের পর বছর কাটানোর ফলে সে তার বেশকিছু যোগাযোগের ত্রুটি দূর করতে সমর্থ হয়! জীবনে একজন ঠিকঠাক বন্ধুজুড়ে গেলে নানাভাবেই সামাজিক যোগাযোগের কার্ভে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।

এখন আমরা বন্ধু হিসেবে কেমন মানুষ পাই? সম্পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্থা কি রাখতে পারি? আমাদের মুখোমুখি যোগাযোগের সুযোগ কি ডিজিটাল মাধ্যমে যোগাযোগের চাইতে কমে আসেনি? যোগাযোগের ক্ষেত্রে কতখানি গভীরতা থাকছে? আমরা কে কার বিপদে পাশে থাকতে পারছি? আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবেশ কি পাশে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে বা ধরে রাখতে পেরেছে? অপরাধ ও সহিংসতা হ্রাসে সামাজিক বন্ধন কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এবং দৃঢ় সামাজিক বন্ধন বিষণ্ণতা ও একাকিত্ব কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে কি? দৃঢ় সামাজিক বন্ধন অপরাধ ও সহিংসতা প্রতিরোধ করে কারণ, এটি সামাজিক নিয়ম, বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। ঠিক এ পর্যায়ে মনে পড়ছে আবুল কাশেম ফজলুল হকের কথা। তার সন্তানের প্রয়াণ হয়েছিল নির্মমভাবে! সন্তানের মৃত্যুর পর তিনি বলেছিলেন, ‘বিচার চাই না, শুভবুদ্ধির উদয় হোক’! তার এমন উক্তি আমাকে দীর্ঘদিন ভাবিয়েছে। কেন তিনি বিচার চাইলেন না? রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা কি এর কারণ?

যা কিছু ইতিবাচক সেটা আঁকড়ে ধরেই এগোনই ভালো। সব পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলে আমরা বলতেই থাকব ওল্ড ইজ গোল্ড! তাহলে আধুনিক সময়ের কার্যকারিতা কি আদৌ থাকে? বলছি কোনো কিছুর কার্যকারিতা ধরে থাকার স্বার্থে নয় বরং যা কিছু ইতিবাচক সেগুলো ধরে রেখেই সামনে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ। অতীতের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, বর্তমানের যা কিছু ভালো এবং ভবিষ্যতের জন্য যা কিছু সাস্টেইনেবল বা টেকসই তা নিয়েই পৃথিবীতে চলমান সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা চাই। সমাধানের ডিজাইনে আমরা উচ্চ পর্যায়ের টেকনোলজি রাখছি; কিন্তু সেখানে উচ্চ পর্যায়ের আবেগ, অনুভূতি, বন্ধন কই? আছে? তাহলে আমরা কোন টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি?

একাধিক প্রজন্মের মধ্যকার সামাজিক বন্ধন কীভাবে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার উপরে প্রভাব ফেলে? একাধিক প্রজন্মের সামাজিক বন্ধন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাবা-মা, দাদা-দাদি ও অন্যান্য বড়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শিশুদের জীবন দক্ষতা হিসেবে নিয়ম, মূল্যবোধ ও সামাজিক আচরণ শেখায়।

বাড়ির আন্তরিক পরিবেশে শিশু গল্প, প্রথা, পারিবারিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমেই দৃঢ় সামাজিক বন্ধন সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। সামাজিক যেকোনো সমস্যা চিহ্নিত করা, সেটা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, সমাধান নিয়ে চিন্তা করা; গঠনমূলকভাবে সমাধানের দিকে না এগিয়ে গেলে সমাধানের পথ হবে মরুভূমির মরীচিকার মতো! বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? এক ছাদের নিচে একাধিক প্রজন্মের বসবাসের সংখ্যা কি বেড়েছে না কমেছে? একক পরিবার শিশুরা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে? ঠিক কি কারণে একক পরিবারের কনসেপ্ট শহর জীবনে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে?

অদ্ভুত বিষয় হলো, আমরা একটা সমস্যা সমাধানের জন্য যখন অনেক কথা ভাবছি তখন সমস্যা আসলে পুরোপুরি সমাধান হচ্ছে না! বরং নানা দিকে মোড় নিচ্ছে! আমরা কি সমাধানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দূরদর্শিতা দেখাতে পারছি না? সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান কি টেকনোলোজির যুগে এত গুরুত্ব পাচ্ছে? সমাধানগুলো কেন নতুন সমস্যা তৈরি করছে তা নিয়েও ভাবার যথেষ্ট সুযোগ আছে বলেই আমি মনে করি।

ডিজিটাল আর মুখোমুখি সম্পর্কের মধ্যে গভীরতার দিক থেকে পার্থক্য সামাজিকভাবে কি প্রভাব ফেলছে? দুই রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। কোনোটা পুরোপুরি ত্যাগ করে আরেকটাকে অবলম্বন করা ভুল সিদ্ধান্ত। দূরের সম্পর্ক কাছে আসার ধারণা ঠিকই আছে; কিন্তু তাই বলে সম্পর্কগুলো কাছে টানার ধারণাও বাতিল করে দেওয়া ঠিক নয়। আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত নানা রকমের মানুষের সঙ্গে কথা বলি, কাজ করি, সম্পর্ক স্থাপন করি; এক কথায় কো-এগজিস্ট করি অর্থাৎ নানা ধর্ম, বর্ণ, পেশা, গোত্র, জেন্ডার ও বিত্তের মানুষের সঙ্গে বসবাস করছি। স্থান ভেদে এই বসবাসের ধরন ভিন্ন। এই যেমন শহরে ডিভোর্সের মাত্রা বাড়ছে। কেন? একজন ব্যক্তির হাস্যকর মন্তব্য চোখে পড়েছিল, নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে! তাই কি? নারী স্বাবলম্বী না হলেও কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না! থেকেই যাচ্ছে!

সামাজিক যেকোনো সমস্যা চিহ্নিত করা, সেটা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, সমাধান নিয়ে চিন্তা করা; গঠনমূলকভাবে সমাধানের দিকে না এগিয়ে গেলে সমাধানের পথ হবে মরুভূমির মরীচিকার মতো! যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা শান্তিময় পরিবেশ কাম্য। এই শান্তিময় পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তবে একার নয়! রাষ্ট্র যদি শক্তিশালী আইনের মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক স্থিরতা নিশ্চিত না করে তাহলে মানুষ একা সম্পর্কের দৃঢ়তা নিয়ে ভেবে শুধু হয়রানী হবে; কিন্তু সমাধানের টেকসই পথ আর খুঁজে পাবে না!

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষাবিষয়ক লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত