ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে বাড়ছে মৃত্যু

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ
সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে বাড়ছে মৃত্যু

বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ বলা হয়েছে তিনটি- সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ এবং আঘাত ও দুর্ঘটনা। সারা বিশ্বে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যান বটে, তবে ৪৫০টির বেশি রোগ ও আঘাতজনিত কারণে ভুক্তভোগী হয়ে অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। কোন কোন রোগে, কী অবস্থায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের নেতৃত্বে নেওয়া এক সমীক্ষায় এ তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশে বছরে আনুমানিক ৮ লাখ ৪৭ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। আর এর পেছনে আছে ২২৬টি রোগ ও আঘাতের কারণ। ৬২টি ব্যাধিকে ৭টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে- এইচআইভি-এইডস ও যক্ষ্মা; ডায়রিয়া, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও অন্যান্য সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি; অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ ও ম্যালেরিয়া; মাতৃরোগ; নবজাতকের রোগ; অপুষ্টিজনিত রোগ এবং অন্যান্য সংক্রামক; মাতৃ, নবজাতক ও অপুষ্টিজনিত রোগ। অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ ও ম্যালেরিয়ার শ্রেণিতে ইয়োলো ফিভার ছাড়া আর সব কটির প্রাদুর্ভাবই বাংলাদেশে আছে।

অসংক্রামক রোগের পাল্লা সবচেয়ে বেশি ভারী। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অসংক্রামক রোগগুলোর ১০টি শ্রেণি। এগুলোতে যত রোগ আছে, তার ১৩০টিতে বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যু হয়। এসবের মধ্যে আছে- ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অস্থিসংক্রান্ত ব্যাধি, সিরোসিস ও অন্যান্য যকৃতের রোগ এবং পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এসবের সঙ্গে আরও আছে মানসিক রোগ। বাংলাদেশে একসময় কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু হতো বেশি। বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও রোগ ব্যবস্থাপনার বিকাশের কারণে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। বিপরীতে গড় আয়ু বৃদ্ধি, জীবনযাপনে পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কারণে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এসব রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে।

২০১৯ সালে মৃত্যুর প্রধান ১০ কারণ ছিল স্ট্রোক, স্কেমিক হার্ট ডিজিজ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়াজনিত রোগ, যক্ষ্মা, সিরোসিস, ক্যানসার ও নবজাতকের অসুখ। আঘাত ও দুর্ঘটনাও আছে বহু ধরনের। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত্যু, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। এসব ধরন আছে মোট ৩৪টি। এই ৩৪ ধরনকে ৪টি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে- সড়ক দুর্ঘটনা; অনিচ্ছাকৃত আঘাত; নিজেকে নিজে আঘাত ও আন্তর্ব্যক্তিক সহিংসতা এবং বলপ্রয়োগ; দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড; মৃত্যুদণ্ড ও পুলিশি সংঘাত।

প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি লোক অসংক্রামক রোগের কারণে মারা যায়, যা বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর হার বাড়ে। প্রতি বছর ৩০-৬৯ বছর বয়সি দেড় কোটি লোক অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে; এই অকালমৃত্যুর ৮৫ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বের মোট রোগের ৮০ শতাংশই হবে এই অসংক্রামক রোগ। বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের মানুষের মৃত্যুর প্রধান ১৫টি কারণের একটি তালিকা প্রকাশ করে। স্ট্রোক ছিল সেই তালিকায় শীর্ষে। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর শীর্ষতম কারণ স্ট্রোক। স্ট্রোকের দুটি ধরন।

একটি রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, আরেকটি মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। দেশে মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশের জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ। অন্য কারণগুলো ছিল- হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, সিরোসিস, অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধি, খাদ্যনালির ক্যান্সার, কিডনির রোগ, আত্মহত্যা, ফুসফুসের ক্যানসার, জরায়ু মুখের ক্যান্সার, ডায়রিয়াজনিত রোগ, সড়ক দুর্ঘটনা ও পতনজনিত মৃত্যু।

বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারে মানুষ মারা যান। মৃত্যু ছাড়াও রোগের কারণে মানুষকে দীর্ঘ সময় অসুস্থ অবস্থায় জীবনযাপন করতে হয়। অনেকে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। ২০১৯ সালের শীর্ষ ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকির তালিকায় ছিল অপুষ্টি, বায়ুদূষণ, উচ্চ রক্তচাপ, তামাক, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, রক্তে অতিমাত্রায় শর্করা, স্থূলতা (Obisity), পেশাগত ঝুঁকি, পয়োব্যবস্থা এবং উঁচু মাত্রার এলডিএল।

খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও বায়ুদূষণসহ নানা কারণে দেশের তরুণদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মকে এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। রোগ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশে কর্মক্ষমতা হ্রাসের হিসেবে অসংক্রামক রোগ ৬১ শতাংশ দায়ী।

এখনই গুরুত্ব দিয়ে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ না করা হলে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এসব রোগের প্রকোপ মারাত্মক আকারধারণ করবে। ফলে, কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমবে এবং সার্বিকভাবে দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে। অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিগুলো কমাতে হলে একে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য ছাড়াও অর্থ, যোগাযোগ, শিক্ষা, কৃষি, পরিকল্পনা ও অন্যান্য খাতকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যবস্থাপনার আওতায় রোগ নির্ণয়, স্ক্রিনিং, চিকিৎসা এবং উপশমক যত্নকে নিয়ে আসতে হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও সময়োপযোগী চিকিৎসা-অসংক্রামক রোগ কমাবার অন্যতম উপায় হতে পারে এবং সেটা প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের মাধ্যমেই সম্ভব। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য এখন যেটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে, বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং যেসব দুর্বলতা আছে, সেগুলো সমাধানের জন্য কৌশল নির্ধারণ করা। সংক্রামক রোগগুলো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক এবং পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট হয়, যা শরীরে প্রবেশ করে এবং সেখানে বংশ বৃদ্ধি পায়। এই রোগগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে, যেমন শ্বাসতন্ত্রের রোগ শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এছাড়া, অনেক সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ভাইরাসের মিউটেশন ঘটতে পারে, যা তাদের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। সঠিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধী পদক্ষেপ ছাড়া সংক্রমণের বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এই সংক্রামক রোগগুলো সাধারণত চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল, ছত্রাকজনিত এবং পরজীবী। প্রতিটি শ্রেণির রোগের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে এবং এই রোগগুলোর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ পদ্ধতি ভিন্ন।

ভাইরাল সংক্রমণ : ভাইরাস মানুষের কোষে প্রবেশ করে এবং সেগুলো ধ্বংস করতে পারে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাইরাল সংক্রমণ: ইনফ্লুয়েঞ্জা (Flu): শীতকালে সাধারণ ভাইরাল রোগ যা জ্বর, কাশি ও গলা ব্যথা সৃষ্টি করে। COVID-19: একটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাল রোগ যা novel SARS-CoV-2 ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু (Dengue) : ভাইরাসবাহিত এডিস মশার (বিশেষ করে এডিস ইজিপ্টাই) মাধ্যমে ছড়ায়।

ছত্রাকজনিত সংক্রমণ : ছত্রাকের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে সংক্রমণ হতে পারে। কিছু সাধারণ ছত্রাকজনিত রোগ, অ্যাথলেট ফুট, পায়ের ফাঙ্গাল সংক্রমণ। ক্যান্ডিডিয়াসিস, একটি ছত্রাকজনিত রোগ যা শরীরের বিভিন্ন অংশে হতে পারে- যেমন কিডনি, লিভার, হাড়, চোখ ইত্যাদি আক্রান্ত হতে পারে।

পরজীবী সংক্রমণ : পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগগুলো সাধারণত বাহ্যিক পরিবেশ থেকে শরীরে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। ম্যালেরিয়া: মশার মাধ্যমে সংক্রমিত একটি মারাত্মক রোগ। এলিসথিয়াসিস: পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ যা মশার মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রামক রোগ নির্ণয় করতে হলে জীবাণু শনাক্ত করতে হবে। আর সে জন্য মাইক্রোবায়োলজিস্টদের কর্মক্ষেত্র বাড়াতে হবে। আমরা প্রতিরোধে এগিয়েছি; কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা সংক্রামক রোগ নির্ণয়ে ও চিকিৎসায় কিছুটা পিছিয়ে আছি। তাই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় সংক্রামক ব্যাধি অধ্যয়ন, নির্ণয় ও চিকিৎসা তিনটিই পদ্ধতিগতভাবে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

সংক্রামক রোগগুলোর প্রতি সচেতনতা, সঠিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যত বেশি আমরা এসব রোগের সম্পর্কে জানতে পারব এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করব, ততই আমরা আমাদের পরিবার এবং সমাজকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হব। ভবিষ্যতে সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিতভাবেই নিরাপদ থাকতে পারব। তবে, মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রে সঠিক ও প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি।

লেখক : গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত