প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
কৃষক বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজারে অস্থিরতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত সঞ্চয় না থাকায় কৃষকরা প্রায়শই আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগেন। ফলে তার ঋণের বোঝা, দারিদ্র্য এবং জীবিকা সংকটে পড়ে যায়।
কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রথমেই প্রয়োজন ফসলের ন্যায্যমূল্য দেওয়া। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও সংগ্রহ ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি কৃষি উপকরণ যেমন, বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার, যাতে উৎপাদন খরচ সহনীয় হয়। কৃষি বীমা চালু করা হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা হঠাৎ ক্ষতির সময় কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পেতে পারে, যা তাদের ঝুঁকি কমাবে। অন্যদিকে কৃষকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য করতে হবে। অনেক কৃষক এখনও মহাজনি বা এনজিও ঋণের ওপর নির্ভর করেন, যা উচ্চ সুদের কারণে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ায়। তাই কম সুদে কৃষিঋণ, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা এবং ডিজিটাল লেনদেন কৃষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এছাড়া কৃষকের জন্য বাজার তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। সময়মতো আবহাওয়ার পূর্বাভাস, রোগ-পোকা দমন ব্যবস্থা এবং উন্নত কৃষি প্রশিক্ষণ কৃষকের উৎপাদনশীলতা ও আয় বাড়াতে সাহায্য করবে।
ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজারে অস্থিরতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত সঞ্চয় না থাকায় কৃষকরা প্রায়শই আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগেন। একই সঙ্গে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমবে।
কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ করা কৃষি উন্নয়ন ও গ্রামীণ জীবিকা সুরক্ষার অন্যতম প্রধান শর্ত। বাংলাদেশের কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজারমূল্যের অস্থিরতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে সবসময় ঝুঁকিতে থাকে। তাই তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
প্রথমত, কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারি ক্রয় কেন্দ্র, কো-অপারেটিভ বিক্রি ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস চালু করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের সুলভ মূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষি ঋণ সহজলভ্য করতে হবে যাতে তারা উচ্চ সুদের ঋণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এছাড়া কৃষি বিমা ব্যবস্থা চালু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি কমানো সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে উৎপাদন খরচ কমানো এবং আয় বৃদ্ধি করা যাবে। একইসঙ্গে কৃষক পরিবারগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার নিশ্চয়তা থাকলে তারা অর্থনৈতিকভাবে আরও স্থিতিশীল হবে। সর্বোপরি, কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং সামাজিক সহযোগিতা, বেসরকারি উদ্যোগ এবং কৃষকদের সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি টেকসই কৃষি অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব।
কৃষকের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কিছু নির্দিষ্ট দিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এরমধ্যে প্রযুক্তি, বাজার ব্যবস্থা, আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং সমবায় উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন উন্নত বীজ, যান্ত্রিক কৃষি সরঞ্জাম, স্মার্ট কৃষি অ্যাপস ও সেচ ব্যবস্থা কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়, যা কৃষকের আয়ের ভিত্তি শক্ত করে।
বাজার ব্যবস্থা : কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করলে কৃষক ন্যায্য দাম পান এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে যায়।
আর্থিক সহায়তা : কৃষকের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, বিমা এবং ভর্তুকি প্রদান করলে তারা বিনিয়োগে উৎসাহী হন। আর্থিক সহায়তা কৃষকদের ঝুঁকি কমিয়ে উৎপাদন ও আয় বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রশিক্ষণ : কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি, ফসলের রোগ-বালাই দমন, জৈব চাষ, পানি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে তারা দক্ষ হয়ে ওঠেন। দক্ষ কৃষকই টেকসই কৃষি উৎপাদনে অবদান রাখতে পারেন। কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে জাতীয় অর্থনীতিও ঝুঁকিতে পড়বে। তাই সরকারি নীতি, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি বীমা, সঠিক বিপণন ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি মিলিয়ে কৃষকের টেকসই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সমবায় উদ্যোগ : কৃষকদের একত্রিত করে সমবায় গড়ে তুললে তারা যৌথভাবে উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। এতে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য, কম খরচে উৎপাদন উপকরণ এবং বড় বাজারে প্রবেশের সুযোগ পান।
সবশেষে বলা যায়, কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে জাতীয় অর্থনীতিও ঝুঁকিতে পড়বে। তাই সরকারি নীতি, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি বিমা, সঠিক বিপণন ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি মিলিয়ে কৃষকের টেকসই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি শুধু কৃষকের নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রযুক্তি, উন্নত বাজার ব্যবস্থা, আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং সমবায় উদ্যোগ একসঙ্গে কাজ করলে কৃষকদের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ