ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যা প্রয়োজন

সৈয়দ আব্দুল হামিদ
স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যা প্রয়োজন

বাংলাদেশে রোগব্যাধির প্রকৃতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। একসময় সংক্রামক রোগ ছিল প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকি; কিন্তু বর্তমানে তার জায়গা নিয়েছে অসংক্রামক রোগ, দুর্ঘটনাজনিত আঘাত, বার্ধক্যজনিত জটিলতা এবং কর্মস্থল-সম্পর্কিত নানা শারীরিক সমস্যা। এ প্রেক্ষাপটে শুধু ওষুধ, অস্ত্রোপচার কিংবা হাসপাতালের শয্যা বাড়ালেই যথেষ্ট নয়; রোগীর পুনর্বাসন এখন স্বাস্থ্যসেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যার মূল চালিকাশক্তি ফিজিওথেরাপি। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও স্ট্রোকের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে শরীরের কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধার অপরিহার্য, যেখানে ফিজিওথেরাপি কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অস্ত্রোপচার করলেও পরে ফিজিওথেরাপির অভাবে অনেকেই পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পান না। অন্যদিকে দ্রুত বাড়তে থাকা প্রবীণ জনগোষ্ঠী আর্থ্রাইটিস, হাঁটু-কোমর ব্যথা, হাড় ক্ষয় ও ভারসাম্যহীনতায় ভোগেন, যেখানে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি তাদের ব্যথা কমায়, চলাফেরার সক্ষমতা ফিরিয়ে আনে এবং স্বনির্ভর রাখে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, স্ট্রোক-পরবর্তী রোগীদের অধিকাংশের রিহ্যাবিলিটেশন প্রয়োজন হয়, আর এ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ফিজিওথেরাপি। বাংলাদেশে প্রতি বছর তিন লাখেরও বেশি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, যাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দীর্ঘমেয়াদি ফিজিওথেরাপি ছাড়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। একইভাবে ক্যান্সার-পরবর্তী রোগী, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভোগা মানুষ ও শিশুদের (যেমন সেরিব্রাল পালসি, অটিজম বা জন্মগত শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত) শারীরিক-মানসিক বিকাশ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও সক্রিয় জীবনে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি অপরিহার্য। ফলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় পর্যায়ে সুস্থতা, উৎপাদনশীলতা এবং জীবনমান উন্নয়নে ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাঠামোর মধ্যে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা এখনও সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে ‘মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ফিজিওথেরাপি)’ নিয়োগের মাধ্যমে এ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাসেবা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে পেশাদার ও মানসম্মত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে রোগীদের বাধ্য হয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে হয়, অথবা সঠিক সেবা না পেয়ে অক্ষম জীবনযাপন করতে হয়। এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগান্তি যেমন বাড়ছে, তেমনি জাতীয় পর্যায়ে দেশ অসংখ্য কর্মক্ষম মানবসম্পদ হারাচ্ছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদিও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল প্রতিষ্ঠান ফিজিওথেরাপি শিক্ষা চালু করেছে। তবে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও বিশেষায়নের সুযোগ এখনো অত্যন্ত সীমিত। দেশের কিছু বিশেষায়িত হাসপাতালে যেমন জাতীয় ট্রমাটোলজি ও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন ইনস্টিটিউট, জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় শ্বাসযন্ত্র রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল- বিশেষায়িত মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে একটি দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি জনবল তৈরি করা জরুরি।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো- পেশাগত মর্যাদার অভাব। ফিজিওথেরাপিকে প্রায়ই গৌণ বা সহায়ক সেবা হিসেবে দেখা হয়। অনেক চিকিৎসক ও রোগী এখনও মনে করেন, ফিজিওথেরাপি শুধু ব্যথা কমানোর একটি উপায়। অথচ উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমে ফিজিওথেরাপিস্টরা চিকিৎসা দলের অপরিহার্য সদস্য। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে প্রাথমিক থেকে তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিটি ধাপে ফিজিওথেরাপিস্টরা সম্পৃক্ত। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় প্রতিটি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে। ভারতের মতো দেশও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ফিজিওথেরাপিকে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত পদ সৃষ্টি করেছে। ফলে রোগীদের চিকিৎসা কার্যকর হচ্ছে, রিহ্যাবিলিটেশন ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফিজিওথেরাপিস্টরা এখন প্রাথমিক মূল্যায়ন ও চিকিৎসা পরিকল্পনায় সরাসরি ভূমিকা রাখছেন। যুক্তরাজ্যে তারা ‘ফার্স্ট কন্টাক্ট প্র্যাকটিশনার’ হিসেবে কাজ করেন, যেখানে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই রোগীর সমস্যা মূল্যায়ন করেন। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় তারা স্বাধীনভাবে চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন। নিউজিল্যান্ডে প্রাথমিক পর্যায়ে পেশি-হাড়ের সমস্যার অধিকাংশ রোগীর সেবা দেন ফিজিওথেরাপিস্টরা। বাংলাদেশেও গ্র্যাজুয়েশন স্তরের ফিজিওথেরাপিস্টদের এ ভূমিকা পালনের জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে, তবে নীতিগত স্বীকৃতি ও পেশাগত মর্যাদার অভাবে তারা তা প্রয়োগ করতে পারছেন না।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ফিজিওথেরাপির প্রয়োজনীয়তা বোঝার জন্য ফিজিওথেরাপিস্টদের ভূমিকা স্পষ্ট করা দরকার। বেসরকারি পর্যায়ে, গ্র্যাজুয়েশন স্তরের ফিজিওথেরাপিস্টরা (যারা ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি বা সমতুল্য ডিগ্রিধারী) সব ধরনের বাত, ব্যথা, প্যারালাইসিসসহ প্রতিবন্ধী এবং প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি এবং অথবা রোগীকে বিভিন্ন পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রয়োগসহ উপদেশ, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন। ফিজিওথেরাপিস্টরা রোগীর অঙ্গ সঞ্চালনে সব ধরনের শারীরিক সমস্যার সমাধান ও প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করে থাকে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় বিভিন্ন ভৌত উপাদান, থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ বা ম্যানুয়াল থেরাপি, ইলেকট্রোথেরাপি, ফার্মাকোথেরাপি, দৈনন্দিন কার্যক্রম সহায়কসামগ্রী, প্রবেশগম্যতা (এক্সেসিবিলিটি), আর্গোনমিক্স এবং গবেষণালব্ধ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে রোগীকে চিকিৎসা ও রিহ্যাবিলিটেশন সেবা প্রদান করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একজন স্ট্রোক রোগীর ক্ষেত্রে নিউরোমেডিসিন স্পেশালিস্ট তার মেডিসিন চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন আর ফিজিওথেরাপিস্ট, একজন স্ট্রোক রোগীকে এসেসমেন্ট করে তার জন্য পূর্ণাঙ্গ রিহ্যাবিলিটেশন ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন ও চিকিৎসা প্রদান করেন, যাতে রোগী তার স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যেতে পারেন। অনেকেই ফিজিক্যাল মেডিসিন বা ফিজিয়াট্রিস্টকে ফিজিওথেরাপি স্পেশালিস্ট মনে করেন। ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন (পিএমআর) হলো অন্যান্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের মতো একটি চিকিৎসা বিশেষত্ব।

উন্নত বিশ্বে সাধারণত তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা (ফিজিয়াট্রিস্ট) রোগ নির্ণয়, ওষুধের প্রেসক্রিপশন এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকেন। অন্যদিকে, গ্র্যাজুয়েশন স্তরের ফিজিওথেরাপিস্টরা (যারা ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি বা সমতুল্য ডিগ্রিধারী) সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। তারা শারীরিক ব্যায়াম, ম্যানুয়াল থেরাপি, ইলেকট্রোথেরাপি এবং রোগী শিক্ষার মাধ্যমে রোগীর কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন স্ট্রোক রোগীর ক্ষেত্রে নিউরোলজিস্টের পাশাপাশি ফিজিয়াট্রিস্ট রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন আর ফিজিওথেরাপিস্ট সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী রোগীকে হাঁটতে, ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং পেশির শক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন। এ দুই পেশার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আবার, অর্থোপেডিক সার্জন অথবা কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান (যেমন রিউমাটোলজিস্ট বা খেলাধুলাজনিত আঘাতসংক্রান্ত চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) ফিজিওথেরাপিস্টদের সরাসরি সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। রোগীকে রেফারেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে পাঠানো হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত