প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের সর্বউত্তরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চগড় এক অনন্য ভূস্বর্গ যেখানে প্রকৃতি কখনও আপন স্নিগ্ধতায়, কখনও প্রচণ্ড বৈপরীত্যে নিজেকে প্রকাশ করে। সমতলভূমির দেশ হয়েও পঞ্চগড়ের ভৌগোলিক উচ্চতা তুলনামূলক বেশি, আর সেই উচ্চতাই এখানকার জলবায়ুকে দিয়েছে ভিন্ন এক চরিত্র। কখনও হাড়-কাঁপানো শীত, কখনও প্রখর গরম, আবার গরমের মধ্যেই ভোরবেলার অদ্ভুত ঠান্ডা এই বৈপরীত্য পঞ্চগড়কে আলাদা পরিচয় দিয়েছে। প্রকৃতির এ পরিবর্তন যেমন মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে, তেমনি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ওপরও রেখেছে স্পষ্ট ছাপ।
শীত এলে পঞ্চগড়ের নাম সবার আগে আসে। উত্তর দিক থেকে নেমে আসা শৈত্যপ্রবাহ, ঘনকুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডা দিনটিকে প্রায় স্থবির করে দেয়। প্রতিবছরই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয় তেঁতুলিয়ায়। ২০১৮ সালের শীতে তাপমাত্রা নেমেছিল 2.6°C -এ যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। শীতকাল এখানে স্বাস্থ্যের জন্য এক প্রকৃত চ্যালেঞ্জ; সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও রিউম্যাটিক ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। অপরদিকে গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপদাহ মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। ত্বকের এলার্জি থেকে শুরু করে ঘামাচি, চর্মরোগ ও হিট র্যাশ সবই যেন নিয়মিত সঙ্গী। গরমের মাঝেও ভোরে হঠাৎ শরীরে ঠান্ডার স্রোত বয়ে যাওয়া আবার মনে করিয়ে দেয় জলবায়ুর অস্বাভাবিকতা।
তবে এই বৈচিত্র্যের মাঝেও পঞ্চগড়কে সবচেয়ে আলাদা করে তুলে ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ, যার উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার। নেপাল ও ভারতের সিকিম সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয়ের বরফঢাকা ওই শৃঙ্গটি শীতের শুরুতে ঝকঝকে নির্মল আকাশে তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায় যা পৃথিবীর সমতলভূমি অঞ্চলে বিরল দৃশ্য। সূর্যের প্রথম সোনালি আলো যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফে পড়ে রুপালি আভা ছড়ায়, তখন মনে হয় দূরের পর্বতমালা যেন পঞ্চগড়ের আকাশে এসে নীরব বসতি গড়ে তুলেছে। এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য প্রতি বছর হাজারো পর্যটক শীতকালে তেঁতুলিয়ায় ভিড় করেন।
প্রকৃতির পাশাপাশি পঞ্চগড়ের ইতিহাস ও অর্থনীতিও সমৃদ্ধ। এখানকার ভূমির উচ্চতা দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় বেশি, আর সেই উঁচুনিচু ভূপ্রকৃতিতে বয়ে চলেছে মহানন্দা, করতোয়া, আত্রাই, তিস্তা ও তিরনইসহ একাধিক নদী।
বহু বছর ধরে এসব নদী থেকে পাথর উত্তোলন ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। হাজারো পরিবার নদীর বুকে পাথর কুড়িয়ে সংসার চালাত। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে সরকার পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দিলে জীবনে আসে নতুন সংগ্রাম বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রয়োজন দেখা দেয়।
এই প্রয়োজন থেকেই পঞ্চগড়ের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে নতুন আলো জ্বলে চা শিল্পের মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া এই শিল্প আজ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদন অঞ্চল। ২২ হাজার একরেরও বেশি জমিজুড়ে এখন সবুজ চা-বাগান বিস্তৃত। এখানকার মাটি, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা চা চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় দ্রুতই এই শিল্প বিকশিত হয়। হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর ‘পঞ্চগড়ের চা’ এখন দেশের রপ্তানি খাতে সম্ভাবনার নতুন অধ্যায়। সবুজ চা-বাগান শুধু অর্থনীতিকে বদলে দেয়নি- পঞ্চগড়ের প্রকৃতিতেও যোগ করেছে এক অন্যরকম নান্দনিক সৌন্দর্য।
অর্থনীতির আরও বড় দরজা খুলে দিয়েছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এটি বাংলাদেশের একমাত্র ত্রি-দেশীয় ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট, যার মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটান সরাসরি বাণিজ্য পরিচালনা করে। চা, আলু, কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন রপ্তানি সামগ্রী পঞ্চগড়কে এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
পাথর উত্তোলনের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে ধরে রেখেছে পঞ্চগড়ের অন্যতম গর্ব রকস মিউজিয়াম। দেশের প্রথম ও একমাত্র পাথরভিত্তিক এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে নদীবন্দরগুলো থেকে সংগৃহীত নানা ধরনের পাথর, ভূস্তরের নমুনা, খনিজ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় ও পাথরশিল্পের ইতিহাস। শিক্ষার্থী, গবেষক ও ভূতত্ত্বপ্রেমীদের জন্য এটি এক মূল্যবান ভাণ্ডার। পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই মিউজিয়ামই যেন অতীতের শিল্পভিত্তিক জীবনের নিঃশব্দ স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও পঞ্চগড় সমৃদ্ধ। মহারাজার দীঘি, মিরগড় প্রত্নস্থল, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, গোলকধাম মন্দির, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, বারো আউলিয়ার মাজার, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট প্রতিটি স্থাপনা যেন সময়ের গল্প বলে। এখানকার আঞ্চলিক খাবার পেল্কা, শিদল ভর্তা, মিরগড়ের টোপাপুষ্টিকর হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
পঞ্চগড় শুধু একটি জেলা নয়; এটি প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, মানুষের জীবন ও অর্থনীতির এক সম্মিলিত গল্প। তেঁতুলিয়ার প্রান্তে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফঢাকা চূড়া দেখা শুধু ভ্রমণের আনন্দ নয় এ এক আত্মিক উপলব্ধি, যেখানে মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজ হাতে মানুষকে তার গভীরতা বুঝতে শেখাচ্ছে। এখানে প্রকৃতি যেমন সৌন্দর্য উপহার দেয়, তেমনি নেওয়াও শেখায়; কখনও কোমল, কখনও কঠোর, কখনও রূপকথার মতো, আবার কখনও বাস্তবতার নির্মমতায় ভরপুর। আর এই বৈপরীত্যই পঞ্চগড়কে করেছে অনন্য, করেছে স্মরণীয়।
জিনিয়া তাবাসসুম
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট