ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রথম ভারতীয় ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস (আইইএস) অফিসার খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)

মো. মনিরুল ইসলাম
প্রথম ভারতীয় ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস (আইইএস) অফিসার খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)

ব্রিটিশ ভারতের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তর ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) আর ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর ছিল ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস (আইইএস)। এখন যেমন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় আইইএস এর নীচে আরও দুটি স্তর ছিল। যার একটি প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিস অন্যটি সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিস। সবচেয়ে নীচের স্তর অর্থাৎ সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিসে চাকরিরতদের অধিকাংশই ছিলেন ভারতীয় আর মধ্যম স্তরে প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসের পদগুলোতে ইউরোপীয়নরা থাকলেও ভারতীয়দের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু আইইএস পদটি ছিল শুধু ইউরোপীয়নদের জন্য সংরক্ষিত। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে আইইএস এর পদ ছিল মাত্র ২২টি। এরাই ব্রিটিশ ভারতের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও তৎপরবর্তী পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের স্বাধিকারের পাশাপাশি ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনযন্ত্রে ভারতীয়দের আরও বেশি অন্তর্ভুক্ত করার বহুমুখী উদ্যোগ নেয়। এ সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিস ও প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসের মতো ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসেও ইউরোপীয়নদের পাশাপাশি ভারতীয়দের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পার্লামেন্টারী কমিটির কাছে এই পদের জন্য ভারতীয় শিক্ষক, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদদের সম্ভাব্য তালিকা চাওয়া হয়।

সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে একজন আত্মবিশ্বাসী শিক্ষাবিদ হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় ইন্সপেক্টর খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার নামও প্রস্তাবে উঠে আসে। ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়

১৯১৯ সালে। তখন ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক এবং প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসের কর্মকর্তারা ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে প্রথমবারের

মতো মাত্র একজন ভারতীয়কে এই পদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই একমাত্র ভারতীয় শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবনধারায় লিখেছেন ‘তৎকালে শিক্ষা বিভাগের যতগুলো আফিসার ছিল সকলেরই পূর্বে আমি ঊর্ধ্বতন উপাধি লাভে সমর্থ হইয়াছিলাম এবং এতদ্দেশীয় কর্মচারীদের মধ্যে আমিই সর্ব্বাগ্রে এর অন্তর্ভূক্ত হইবার উপযোগী মনোনীত হইয়াছিলাম।’ পদমর্যাদা এবং বেতনক্রমে পদটি ছিল ভারতীয়দের কাছে স্বপ্নের মতো। ১৯২২ সালে একজন ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস কর্মকর্তার মাসিক মূল বেতন ছিল ১০২০ টাকা, প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিস কর্মকর্তার মাসিক মূল বেতন ৫২০ টাকা এবং সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিস কর্মকর্তার মাসিক মূল বেতন ছিল ১১৭ টাকা। পদমর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধায়ও আইইএস ছিল সর্বোচ্চ।

১৯১৭ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় শিক্ষা প্রশাসনের তিনস্তরে ভারতীয় এবং ইউরোপীয়ন কর্মকর্তাদেও তালিকার তুলনামূলক পরিসংখ্যানটি আমাদেরকে তৎকালীন চিত্র বুঝতে সহায়তা করবে। ১৯১৭ সালে মোট আইইএস অফিসার ছিলেন ২২ জন, যার সবাই ছিলেন ইউরোপীয়ন। এ সময় প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে মোট ৪০টি পদের মধ্যে ৩৪ জন ভারতীয় এবং সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিসে মোট ৬৪০ পদের মধ্যে ৬৩৫ জন ছিলেন ভারতীয়। ১৯১৯ সালে মোট আইইএস অফিসার ছিলেন ২২ জন, যার প্রথমবারের মতো মাত্র একজন ভারতীয়কে আইইএসে অর্ন্তভূক্ত করা হয়। আর এই প্রথম ভারতীয় আইইএসই ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা।

এ সময় প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে মোট ৪২টি পদের মধ্যে ৩৫ জন ভারতীয় এবং সাবঅর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিসে মোট ৬৯৪ পদের মধ্যে ৬৯১ জন ছিলেন ভারতীয়। ১৯২২ সালে মোট আইইএস অফিসার ছিলেন ২২ জন, যার মধ্যে ছয়জন ছিলেন ভারতীয় এবং এ সময় প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে মোট ৫৫টি পদের মধ্যে ৪৭ জন ভারতীয় এবং সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিসে মোট ৭৭৩ পদের মধ্যে সবাই ছিলেন ভারতীয়।

উল্লেখ্য, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ১৮৯৬ সালে সাব-অর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯০৮ সালে তিনি প্রভেন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে উন্নীত হয় এবং ১৯১৯ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে আইইএস-এ অন্তর্ভূক্ত হন। আইইএস-এ অন্তর্ভূক্ত হবার ৫ বছরের মধ্যে ১৯২৪ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা প্রশাসনের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিবাগের সহকারী পরিচালক পদে আসীন হন এবং ১৯২৯ সালে অবসরের পূর্বে কিছুদিন শিক্ষা বিভাগের পরিচালক (চলিতি দায়িত্ব) পদে আসীন হয়েছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপুল অবদান ও আমূল সংস্কার সাধন করেন।

মো. মনিরুল ইসলাম

লেখক : পরিচালক, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত