প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু চারিদিকে তখন শুধু হাহাকার। পাকিস্তানিরা যাওয়ার সময় সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট ভাঙা। রেললাইন উপড়ানো। গুদামে এক দানা খাবার নেই। ব্যাংকে টাকা নেই। কলকারখানাগুলো বন্ধ। গ্রামের পর গ্রাম শুধু পোড়া ছাই। সেই দৃশ্য দেখে বিশ্বের বড় বড় পণ্ডিতরা তখন নাক সিটকেছিলেন। কেউ কেউ বললেন, এই দেশ টিকবে না। এটা হবে একটা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। মানে এখানে যতই সাহায্য দেওয়া হোক, সব তলিয়ে যাবে। কিন্তু তারা বাঙালিকে চিনতে ভুল করেছিলেন। তারা জানতেন না, এই মাটির মানুষের মনের জোর কত বেশিনফ গ্রীক পুরানে একটি পাখির গল্প আছে। তার নাম ফিনিক্স পাখি। এই পাখি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আবার সেই ছাই থেকেই জ্যান্ত হয়ে আকাশে ওড়ে। বাংলাদেশ ঠিক সেই পাখির মতো। একাত্তরের সেই পোড়া মাটি থেকেই আমরা নতুন করে জন্ম নিয়েছি। আজ চুয়ান্ন বছর পর পেছনে তাকালে অবাক হতে হয়। শূন্য হাতে শুরু করা সেই দেশটি আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে!
স্বাধীনতার পরপর আমাদের প্রধান চিন্তাই ছিল পেটের ক্ষুধা। দেশে তখন মানুষ ছিল সাত কোটি। অথচ খাবার ছিল না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে খাবার আনতে হতো। আর আজ? মানুষ বেড়েছে প্রায় তিনগুন।
২০ কোটিরও বেশী জনসংখ্যার দেশ। জমির পরিমানও কমেছে অনেক, তবুও কেউ আর না খেয়ে মরে না। ভাতের জন্য হাহাকার নেই। আমাদের কৃষক ভাইয়েরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে এই অসাধ্য সাধন করেছেন। আমরা এখন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও খাবার পাঠাই। মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বসেরাদের তালিকায়। সবজি চাষে বিপ্লব ঘটে গেছে। যেই দেশকে বলা হয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই ঝুড়ি এখন খাদ্যে ভরপুর। আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে পোশাক শিল্প। আশির দশকে ছোট করে শুরু হয়েছিল এই ব্যবসা। আজ বিশ্বের বুকে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এক গর্বের নাম। আমাদের গ্রামের লাখ লাখ মা-বোন এই শিল্পের কারিগর। যে মেয়েরা আগে ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পেত, তারা এখন অর্থনীতির হাল ধরেছে।
চীনের পরেই এখন আমরা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করি। এর সাথে আছে আমাদের প্রবাসী ভাইবোনেরা। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে বা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে যারা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন, তারা তাদের উপার্জিত সবটুকু টাকা দেশে পাঠান। বিশ্ব অর্থনীতির নানা সংকটের সময়েও এই রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে। যখন বড় বড় দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ে, তখন আমাদের গ্রামের অর্থনীতি সচল থাকে এই প্রবাসীদের টাকায়।
একসময় ভাবা হতো, বড় বড় কাজ করার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। পদ্মা সেতু সেই ধারণাকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন টাকা দেবে না বলে জানিয়ে দিল, তখন আমরা জিদ ধরলাম। নিজেদের পকেটের টাকায় আমরা পদ্মা সেতু বানালাম। প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই সেতু। এটি শুধু ইট-পাথরের সেতু নয়, এটি আমাদের সক্ষমতা আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। আজ ঢাকায় মেট্রো রেল চলে। মাটির নিচ দিয়ে, ওপর দিয়ে ট্রেন চলে। নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল বা সুড়ঙ্গ পথ তৈরি হয়েছে। যেই দেশের গ্রামে একসময় হারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে সন্ধ্যা পার করতে হতো, সেই দেশের ঘরে ঘরে আজ বিদ্যুৎ। এমনকি আমরা এখন মহাকাশেও পৌঁছে গেছি। আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট এখন পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। লাল-সবুজের পতাকা এখন আক্ষরিক অর্থেই আকাশ ছুঁয়েছে। তবে এই আকাশ ছোঁয়ার গল্প শুধু দালানকোঠা বা টাকার অংকের নয়। মানুষের জীবনের মানও বেড়েছে। আগে কলেরা বা ডায়রিয়ায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। এখন চিকিৎসার অভাবে মানুষ খুব কম মারা যায়। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে অনেক। মা ও শিশুদের মৃত্যুর হার কমেছে। ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়। বছরের প্রথম দিনেই তারা নতুন বই হাতে পায়। পাকিস্তান নামের যেই দেশটি আমাদের শোষণ করত, আজ তারা সবদিক থেকে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে। তাদের টাকার মান কমেছে, অশান্তি বেড়েছে। আর আমরা এগিয়ে গেছি বহুদূর। এটাই হয়তো ইতিহাসের সেরা প্রতিশোধ।
অবশ্য আমাদের সব সমস্যা মিটে গেছে তা নয়। এখনো আমাদের অনেক পথ চলা বাকি। দেশে এখনো ধনী আর গরিবের মধ্যে অনেক তফাত। দুর্নীতি নামের উইপোকা আমাদের অনেক অর্জন খেয়ে ফেলছে। বাজারে জিনিসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়। তরুণদের জন্য আরও চাকরির সুযোগ তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমরা হতাশ নই। কারণ আমরা লড়াকু জাতি। যে জাতি খালি হাতে ট্যাংকের সামনে দাঁড়াতে পারে, তারা যেকোনো বাধা পার করতে পারে।
একাত্তরে আমরা পেয়েছিলাম এক খণ্ড জমি আর একটা পতাকা। আজ আমরা পেয়েছি বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সম্মান। আমাদের কৃষকের ঘাম, শ্রমিকের শ্রম আর প্রবাসীর ত্যাগে গড়ে উঠেছে আজকের এই বাংলাদেশ। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে আমরা আকাশ ছুঁয়েছি। আমাদের এই অগ্রযাত্রা আর থামবে না, থামানো যাবে না। ফিনিক্স পাখির মতোই আমরা উড়ব। কেবল আকাশই আমাদের সীমানা।
ইব্রাহীম খলিল সবুজ
আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়