মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কোনোভাবেই কমছে না। বাজারে খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখি চাপের মধ্যেই জ্বালানি তেল ও ভোক্তাপর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে দেশের মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরো বাড়ছে। রমজান সামনে রেখে এরইমধ্যে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিও হঠাৎ লাফ দিয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই এলপিজির দাম বাড়াল সরকার।
জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দামের পর এবার এলপিজির দাম বাড়নো হয়েছে। গতকাল রোববার নতুন এ দামের ঘোষণা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। যা গতকাল সন্ধ্যা থেকে কার্যকর হয়েছে। প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৫৯ টাকা থেকে ১৯ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম ৮৯ পয়সা বাড়িয়ে ৬৭ টাকা ৭৪ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল এলপিজির দাম। তবে গত ১৪ জানুয়ারি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৪ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৫৯ টাকা পুনঃর্নিধারণ করা হয়। এদিকে জানুয়ারি শুরুতে ৩ পয়সা কমিয়ে ৬৬ টাকা ৭৯ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল অটোগ্যাসের দাম। এরপর গত ১৪ জানুয়ারি অটোগ্যাসের দাম ৪৯ পয়সা বাড়িয়ে ৬৭ টাকা ২৭ পুনর্নির্ধারণ করা হয়। আর গত ২২ জানুয়ারি ৪২ পয়সা কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয় ৬৬ টাকা ৮৫ পয়সা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ সংস্থাটির কার্যালয়ে গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলন করে এ নতুন দাম ঘোষণা করেন। সংস্থাটি প্রতি মাসেই এলপিজির দাম নির্ধারণ করে। তবে বাজারে নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি না হওয়ার অভিযোগ আছে। এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গৃহস্থালির কাজে।
বিইআরসির নতুন দর অনুযায়ী, বেসরকারি এলপিজির মূল্য সংযোজন করসহ (মূসক/ভ্যাট) দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ১২৩ টাকা ১৬ পয়সা, যা গত মাসে ছিল ১২১ টাকা ৫৬ পয়সা। এই হিসাবে বিভিন্ন আকারের এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারিত হয়। সরকারি কোম্পানির সরবরাহ করা এলপিজির সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৬৯০ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আর গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির (অটো গ্যাস) নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি লিটার ৬৭ টাকা ৭৪ পয়সা, যা আগে ছিল ৬৬ টাকা ৮৫ পয়সা।
জানা গেছে, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি। এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এই দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এই সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি। আমদানিকারক কোম্পানির চালান (ইনভয়েস) মূল্য থেকে গড় করে পুরো মাসের জন্য ডলারের দাম হিসাব করে বিইআরসি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় গত শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের বাজারে ফের বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম। এরমধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া পেট্রোল ও অকটেনের দামও বাড়ানো হয়েছে ১ টাকা। গত শনিবার থেকে তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস বা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্যে প্রাইসিং ফর্মুলার আলোকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ মাসের জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্য জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ১০৪ টাকা থেকে ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৫ টাকা এবং কেরোসিন ১০৪ টাকা থেকে ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৫ টাকা পুনর্র্নিধারণ বা সমন্বয় করা হয়েছে। এছাড়া পেট্রোল ও অকটেনের দামও বাড়ানো হয়েছে ১ টাকা। পেট্রোল ও অকটেনের দাম যথাক্রমে নির্ধারণ করা হয়েছে ১২২ টাকা ও ১২৬ টাকায়।
বাজারে খাদ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন জ্বালানি তেল ও এলপিজির অতিরিক্ত দাম নিয়ে সংসারের হিসাব সমন্বয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন সীমিত আয়ের মানুষ। ঢাকার ও গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, জিনিসপত্রের এরকম মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে। জানুয়ারি মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর ফেব্রুয়ারিতে এলপিজির দাম বাড়ানো হয়েছে। রাজধানীর ডেমরা এলাকার বাসিন্দা তৌহিদ হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বহু বছর ধরে ভবনে লাইনের গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ আছে, এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডার ব্যবহৃত হয় গৃহস্থালির কাজে। এভাবে এলপিজির দাম বাড়লে সংসারের মাসিক ব্যয় চালানো কষ্টকর হয়ে পড়বে। নানারকম কাটছাঁট করার পরেও গত এক বছরে তার সাংসারিক খরচ দেড়গুণ বেড়ে গেছে। কারণ বাজারের প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে।
শ্যামলী রিংরোডের বাসিন্দা আহসান হাবিব বলেন, বাজারে চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ প্রায় প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে। আমাদের আয় তো সেই হিসাবে বাড়েনি। সংসারে আর কোনো আইটেমটা বাদ দেবো? এদিকে ছেলেমেয়ের স্কুলের পড়ার খরচ বেড়েছে, যাতায়াত খরচ বেড়েছে, বাড়িভাড়া বেড়েছে।
প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম সরকার ১ হাজার ৪৫৯ টাকা নির্ধারণ করলেও যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দারা কখনোই সেই দামে এলপিজি সিলিন্ডার কিমতে পারেননি। তারা প্রতিটি ১২ কেজি সিলিন্ডার ১৬শ’ টাকায় কিনতে হয়েছে। নতুন করে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৯ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৭৮ টাকা নির্ধারণ করলেও মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দারা সেই দামে কিনতে পারবেন না। মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা গাজলা শাহীন বলেন, কোনো কারণ বুঝতে পারছি না। সরকারের নির্ধারিত দাম আছে ১ হাজার ৪৫৯ টাকা, তাও সেটা দিতাম।
দোকানদাররা বলছে, ১৬০০ টাকার নিচে সিলিন্ডার নেই। এলপিজি গ্যাসের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও বরাবরই অভিযোগ ওঠে যে, বাজারে এর চেয়ে অনেক বেশি দাম নেয়া হয়। কিন্তু এখন এলপিজি গ্যাসের দাম যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকার খুচরা এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রেতা সাদ্দাম হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মার্কেটে সিলিন্ডারের সাপ্লাই কমেছে। কোম্পানি থেকে নাকি মাল আসছে না। আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে বিক্রিও করতে হয় বেশি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি। তার সঙ্গে যদি জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে মানুষের কষ্ট বাড়ে এবং তাদের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসব জিনিসের যখন দাম বাড়ে তখন অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়।