ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রাদেশিক শাসনের প্রস্তাব

প্রাদেশিক শাসনের প্রস্তাব

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দিয়েছে সংস্কার কমিশন। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায় সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী।

জানা গেছে, সুপারিশমালায় প্রশাসন সংস্কারের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধির বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি সেবা জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কমিয়ে ঢাকাসহ পুরোনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নারী মেম্বার নির্বাচিত হবেন এবং মেম্বারদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন, দুর্নীতিতে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধরতে কমিশন গঠন, একীভূত ক্যাডার বাতিল করে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করা, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়-বিভাগ কমিয়ে ২৫ ও ৪০টি করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারের দায়িত্ব নিয়েই রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দিকে নজর দেন ইউনূস। এরই অংশ হিসেবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গত ৩ অক্টোবর ১১ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমার কথা থাকলেও পরে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার হাতে জনপ্রশাসন সংস্কারের সুপারিশমালা তুলে দেয়া হয়েছে।

একীভূত ক্যাডার বাতিল করে ১৩টি ক্যাডারে বিভক্ত : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় একীভূত ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে ১৩টি ক্যাডারের বিভক্তের কথা বলা হয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার বিষয়টি সামনে রেখে আলাদা আলাদা নামকরণ করা যেতে পারে। সুপারিশমালায় বলা হয়- বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস, বাংলাদেশ বিচারিক সার্ভিস, বাংলাদেশ জননিরাপত্তা সার্ভিস, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সার্ভিস, বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস, বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস, বাংলাদেশ রাজস্ব সার্ভিস, বাংলাদেশ প্রকৌশল সার্ভিস, বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিস, বাংলাদেশ তথ্য সার্ভিস এবং বাংলাদেশ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস থাকতে পারে।

প্রশাসন ক্যাডার হ্রাস : উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, বাস্তবতার নিরিখে প্রশাসনিক সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় বর্তমানে উপসচিব পদের মধ্যে ৭৫ ভাগ এ সার্ভিসের জন্য সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা রাখা আছে। সব সার্ভিসের মেয়াদি সমতা বজায় রাখার স্বার্থে এবং জনপ্রশাসনের উচ্চতর পদে মেধাবীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন প্রশাসনিক সার্ভিসের ৭৫ শতাংশ কোটা হ্রাস করে ৫০ শতাংশ করার বিষয়টি অধিকতর যৌক্তিক মনে করছে।

মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কমানোর প্রস্তাব : বর্তমানে ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। এ সংখ্যা কমিয়ে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার কথা সুপারিশমালায় বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়কে পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়, কমিশন সব মন্ত্রণালয়কে সমপ্রকৃতির পাঁচটি স্বল্প মেয়াদি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করছে। মন্ত্রণালয়/বিভাগকে পাঁচটি গুচ্ছে বিন্যস্ত করা যেতে পারে- (ক) বিধিবদ্ধ প্রশাসন (খ) অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য (গ) ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ (ঘ) কৃষি ও পরিবেশ (ঙ) মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন। মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোর সাংগঠনিক ও মধ্য জনবল কাঠামো সংস্কারের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের উদ্যোগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মেয়াদি আলোচনা করে অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোর সাংগঠনিক ও জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করতে হবে। বিদ্যমান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগে মধ্য পরিকল্পনা কোষ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি যাতে মেয়াদি আরো কার্যকরভাবে সম্পাদন করা যায় সেজন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগে নীতি এবং পরিকল্পনা অধিশাখা/অনুবিভাগ গঠন করে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ জনবল নিয়োগ করতে পারে।

মুখ্য সচিব নিয়োগ : মন্ত্রণালয়গুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে একাধিক বিভাগ সৃষ্টি হবে। বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সেসব মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একজন সচিবকে মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বর্তমান সিনিয়র সচিব নামকরণ বাদ দেয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও সচিব পদে কোনো বেতন গ্রেড বা স্কেল থাকবে না। সরকার তাদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি নির্ধারণ করবেন।

দুর্নীতিবাজ সরকারি চাকরিজীবীদের ধরতে কমিশন গঠন : অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোট জালিয়াতি, অর্থপাচার, দুর্নীতি এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। অন্যদিকে, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮-এর ৪৫ ধারা সংশোধন করে কোনো সরকারি কর্মচারীর ২৫ বছর চাকরিকাল পূর্তিতে তাকে সরকার থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার বিধান বাতিল করার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে বিধান রাখা যায় যে, কোনো সরকারি কর্মচারী ১৫ বছর চাকরি পূর্তিতে অবসর নিতে আবেদন করলে সরকার তা মঞ্জুর করতে পারবে। এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। বিশেষ করে বিভিন্ন সার্ভিসের নামে যেসব সমিতি রয়েছে তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার পরিচয় দিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বা দাবি আদায়ের জন্য কোনো বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারবেন না। ব্যক্তি হিসেবে কেউ সংক্ষুদ্ধ বা বৈষম্যের শিকার হলে তার প্রতিকারের জন্য তিনি বিধিমোতাবেক আবেদন করতে পারবেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা কোনো গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথা বাতিল করার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পূর্বে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা যাবে না। বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিয়োগের পূর্বে পুলিশ বিভাগের কাছে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না সে সম্পর্কে প্রতিবেদন চাইবে। প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রতিবেদন চাইতে পারে। পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরিবর্তে প্রার্থীর যোগদানকৃত মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্পাদিত হবে। এছাড়া পাসপোর্ট, দ্বৈত নাগরিকত্ব, সমাজসেবা সংস্থা বা এনজিওর বোর্ড গঠন ইত্যাদি নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম বাতিল করার জন্যও সুপারিশ করা হলো। একজন নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র থাকলে তার বিষয় নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।

বিমানবন্দরে পুলিশের পরিবর্তে ইমিগ্রেশন অফিসার নিয়োগ : বর্তমানে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে পুলিশ অফিসাররা দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ অফিসারদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ অনেক সময় যাত্রীবান্ধব হয় না। বিশ্বের বহু দেশে পুলিশের পরিবর্তে আলাদা ইমিগ্রেশন অফিসার নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশেও যোগ্যতার ভিত্তিতে পৃথক ইমিগ্রেশন অফিসার নিয়োগ করা যেতে পারে। সেখানে পুলিশ থেকে ২০ শতাংশ ডেপুটেশনে রাখা যেতে পারে। ইমিগ্রেশন অফিসারদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে।

রেজিস্ট্রি অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত : ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস বর্তমানে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে থাকে। অপরদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও হস্তান্তর সংক্রান্ত দুটি আলাদা অফিস থাকায় জনদুর্ভোগ ও জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এমন দ্বৈত ব্যবস্থাপনা বাতিল করে ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিসকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করার জন্য সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত