ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে গাজা দখলে নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা থামছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড ও জাতিসংঘ তার বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ফিলিস্তিনিদের বৈধ আকাঙ্ক্ষার ওপর আঘাত এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছে দেশগুলো। ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর ধ্বংসযজ্ঞের এক মাস না পেরোতেই গাজা দখলের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প গাজা নিয়ে তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। জানান ফিলিস্তিনিদের দেশছাড়া করে অঞ্চলটি পুননির্মাণ করার কথা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়ায় তার দেশের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই তাদের ঘরে ফিরতে দিতে হবে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে সংকটপূর্ণ আখ্যা দিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই গাজা ও পশ্চিমতীরে নিরাপদে বাস করা এবং উন্নয়নের সুযোগ পেতে হবে। ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিষয়ে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তার এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এটি ফিলিস্তিনিদের বৈধ আকাঙ্ক্ষার ওপর আঘাত এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য একটি বড় বাধা। গাজাকে ফিলিস্তিনিদের ভূমি আখ্যা দিয়ে স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসে ম্যানুয়েল আলবারেস বলেন, অঞ্চলটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে গাজাবাসীর আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান একই রয়েছে, যেমনটি ছিল আজ সকালে, যেমনটি ছিল গত বছর এবং ১০ বছর আগে। আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেন, দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। গাজার জনগণকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার যে-কোনো পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের বিরোধী। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভল্কার তুর্ক বলেন, গাজা থেকে লোকজনকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া অবৈধ। ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সামাজিক মাধ্যমে দেয়া পোস্টে সংস্থাটি বলেছে, গাজা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন্তব্য বেআইনি ও ভয়ংকর। জোরপূর্বক উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেয়াকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে অ্যামনেস্টি।
গাজাবাসীকে নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেছে চীন, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসর, জর্ডান, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, গাজার শাসক হামাস, আরব লীগ ও ওআইসি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা আশা করে, সব পক্ষই যুদ্ধবিরতি ও সংঘাত-পরবর্তী শাসনকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে, যাতে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের বিষয়টিকে রাজনৈতিক সমাধানের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যায়। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, রাশিয়া মনে করে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মীমাংসা কেবল দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তিতেই সম্ভব। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকায়ি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পরিকল্পনার কঠোর নিন্দা করছে তেহরান। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ইসরায়েলের সীমান্ত বৃদ্ধির পরিকল্পনা এবং ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় মুছে ফেলার ভয়াবহ নীলনকশা বলে মন্তব্য করেন ইসমাইল বাকায়ি। ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন হামাসের সিনিয়র নেতা ইজ্জাত আল-রিশক। তিনি বলেন, ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্বাসন এবং গাজা উপত্যকার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিবৃতিকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।’ তিনি বলেন, এ ধরনের বিবৃতি ফিলিস্তিন এবং এই অঞ্চল সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও গভীর অজ্ঞতার প্রতিফলন। গাজা অবশ্যই সাধারণ কোনো ভূখণ্ড নয় এবং এটি এমন কোনো সম্পত্তি নয়, যা কেনা-বেচা করা যায়। ট্রাম্পের মন্তব্য প্রমাণ করে যে, ইসরায়েলের প্রতি এবং আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ও তাদের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত রয়েছে। সৌদি আরব দ্রুত ও কঠোর বিবৃতিতে বলেছে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে তাদের অবস্থান দৃঢ়, অবিচলিত ও অপরিবর্তনশীল। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘের প্রতি ফিলিস্তিনি জনগণ এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প যা করতে চাচ্ছেন, তা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, গাজা দখলের পরিকল্পনা সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য। ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে করা যে কোনো পরিকল্পনা আরো বেশি সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। গাজার মালিকানা গ্রহণের ব্যাপারে ট্রাম্পের আহ্বানের আগেই মিসর ও জর্দান ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের দেশে স্থানান্তর করার পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশ দুটি বলেছে, ফিলিস্তিনিদের গাজা ভূখন্ডের বাইরে স্থানান্তর না করেই গাজার পুনর্নির্মাণ করতে হবে। আরব লীগ ট্রাম্পের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এই বক্তব্য অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির রেসিপি এবং আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। দেড়শ কোটি মুসলিমের প্রতিনিধিত্বকারী ওআইসি বলেছে, গাজা ফিলিস্তিনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফিলিস্তিনের ভৌগলিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের যে কোনো পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে সংস্থাটি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলের ঘোষণার পর নিজেদের ঘরবাড়িতে আরো ব্যাপক হারে ফিরতে শুরু করেছেন গাজাবাসী। তাদের দাবি, ‘আমরা আমাদের মাতৃভূমিতেই বাঁচব এবং এখানেই মৃত্যুকে বরণ করব।’ এক বাসিন্দার দাবি, যুদ্ধ এবং বোমাবর্ষণ তাদের গাজা থেকে সরাতে পারেনি, ট্রাম্পও তা করতে পারবে না। গাজাযুদ্ধ চলাকালীন অনেক ফিলিস্তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তারা ১৯৪৮ সালের মতো আবারও নাকবা বা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন। অবৈধ ইসরায়েলি রাষ্ট্র গঠনের ওই সময় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিলেন। ৬৫ বছর বয়সি উম তামের জামাল গত বুধবার বলেন, আমরা আমাদের এলাকা ছাড়ব না। আমরা আমাদের সন্তানদের শিখিয়েছি, তারা কখনও তাদের ঘর ছেড়ে যাবে না এবং দ্বিতীয় নাকবা ঘটতে দেবে না। আরেকজন বলেছেন, গাজাবাসী অবিরাম বোমাবর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সহ্য করে গাজাতেই অবস্থান করেছে। আমরা এখানেই থাকব এবং গাজাকে পুনর্নির্মাণ করব। আমরা এই ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন আরেক গাজাবাসী। তার দাবি, আমরা রক্তপাত, ধ্বংস, বাস্তুচ্যুতি এবং আমাদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক বিতাড়নের শিকার হয়েছি। এটি আমাদের অধিকার, আমাদের মাতৃভূমি, আমাদের পরিচয়। কেউ আমাদের এখান থেকে বের করে দিতে পারবে না। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার ব্যাখ্যা দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ট্রাম্প কেবল গাজার ধ্বংসস্তূপ সরাতে চান। আর তা করতে হলে উপত্যকাটির মানুষকে অন্য জায়গায় সরে যেতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কঠোর কোনো পদক্ষেপের কথা বোঝাননি বলেও দাবি করেন তিনি। রুবিও বলেন, ‘প্রস্তাবটি শত্রুভাবাপন্ন ছিল না। আমি মনে করি, এটি একটি অত্যন্ত উদার পদক্ষেপ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট গাজা থেকে ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার ও সমস্ত অবিস্ফোরিত বিস্ফোরক পরিষ্কার করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে গাজায় বসবাসকারী লোকজন সেখানে থাকতে পারবে না।’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ট্রাম্প গাজার বাড়িঘর, ব্যবসা এবং এই ধরনের অবকাঠামো পুনর্গঠনে সমর্থন করতে চান, যাতে লোকজন আবার সেখানে ফিরে যেতে পারে।’ এদিকে, ডেমোক্র্যাট দলীয় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য ও ফিলিস্তিনি-মার্কিন রাশিদা তালিব বলেন, ফিলিস্তিনিরা কোথাও যাবে না। গণহত্যা ও জাতিগত নিধনে অর্থায়নের জন্য কংগ্রেসে দ্বি-দলীয় সমর্থনের কারণেই প্রেসিডেন্ট এই ধর্মান্ধ উগ্র মন্তব্য করতে পেরেছেন। এখনই সময় আমার দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সমর্থনকারী সহকর্মীদের সরব হওয়ার।