ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিশাল ক্ষত সারানোর চেষ্টা

বিশাল ক্ষত সারানোর চেষ্টা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ছয় মাস পেরিয়ে সাত মাসে পড়েছে। এসময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পাশাপাশি ভঙ্গুর অর্থনীতি টেনে তোলার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি রুখতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নীতকরণ, পণ্যসামগ্রী আমদানি-রপ্তানি, প্রবাসী আয় বাড়ানোসহ আমলাতন্ত্রে স্থিতিশীলতা ফেরানোর জোরালো ভূমিকা রাখছে ইউনূস সরকার।

গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরেই সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের দাবি-দাওয়া আদায়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ-কর্মসূচি পালন করেন। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ১৩৬টির বেশি বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বিক্ষোভ সামাল দিতে হয়েছে। এমনকি সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আহতরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। পরে গভীর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তাদের বুঝিয়ে হাসপাতালে ফেরত পাঠান। আহতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেছেন, ‘গুরুতর আহতদের হাসপাতালে রেখে শারীরিক পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপি দেয়া হবে। এছাড়া জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে শহীদ পরিবারের নিকটতম কোনো সদস্যকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। শহীদ পরিবারের কাছের সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থাও করা হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অপ্রত্যাশিত ভয়াবহ বন্যার। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে ১১ জেলায় ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এছাড়া বন্যায় কমবেশি ১৮ জনের প্রাণহানি হয়। বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় সরকারের আর্থিক ও ত্রাণের সহযোগিতার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতারা গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অর্থ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছেন। সেই পাচার করা বিপুল অর্থ দেশে ফেরানোসহ ভঙ্গুর অর্থনীতি সচল ও বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছে ইউনূস সরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারকাজ, অচল মেট্রোরেলের স্টেশন সংস্কার শেষে চালু, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে। প্রশাসনে অস্থিরতা, ‘বঞ্চিত’ পেশাজীবী-শ্রমজীবীদের বিক্ষোভের মধ্যে সংস্কারে উদ্যোগী ও ঐক্যের পথে এগিয়ে চলছে। সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বাড়ালেও তা কৌশলে মোকাবিলা করছে। শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। বর্তমান সরকার শিক্ষা, অর্থনীতি, শ্রম খাত, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন ও ব্যবসায় পরিবেশ, প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে এগিয়ে চলছে অন্তর্বর্তী সরকার।

নতুন সরকারের কাছে কেউ আসেন চাকরি জাতীয়করণের জন্য, কেউ গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠনের পর সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। জুলাই-আগস্ট গণহত্যা নিয়ে বিচারকাজ শুরু করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এছাড়া পৃথক অভিযোগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক মন্ত্রী-ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া অনিয়মের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের ধাপে ধাপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার করছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র‍্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামি করা হয়।

গুরুত্ব বাড়নো হয়েছে যেসব বিষয়ে : জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ, শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠন। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করে পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্তদের তালিকা তৈরি, ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করে বাতিল করা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন; মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো ও দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল তৈরি পোশাক খাতকে ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের আন্দোলন প্রশমিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের অপপ্রচারকেও বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে ইউনূস সরকার। শ্রমিক অস্থিরতা কমিয়ে উৎপাদনমুখী করা হয়েছে তৈরি পোশাক খাতকে। জনপ্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে গত ছয় মাসে বহু সংস্কার করা হয়েছে।

স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিক সংস্কারকে ঘিরে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের কাছে সংস্কারের নানা প্রস্তাব উপস্থাপন করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের ঘোষণা এলেও তাতে পুরো সন্তুষ্ট নয় রাজনৈতিক দলগুলো। মহা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত ড. ইউনূস সরকারের কাঁধে শুধু দেশ পরিচালনা নয়, সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথরেখা তৈরির দায়িত্বও। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা জনপ্রত্যাশা পূরণে কতটা সফল হবে তা সময়ই বলে দেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত