ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে সিন্ডিকেট

ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে সিন্ডিকেট

বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হচ্ছে না। ফলে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল বাড়তি দামে ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে। রাজধানীর অনেক স্থানে খুচরা ব্যবসায়ীরা বোতলজাত তেল ভেঙে খুচরায় বিক্রি করছেন। কারণ বোতলজাত তেলের চেয়ে খুচরায় বেশি লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিনিয়ত তেল কিনতে গিয়ে ঠকছেন ক্রেতারা। বাজারের এমন অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে সরকারের মনিটরিংয়ের চরম গাফিলতি রয়েছে।

সরেজমিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনিআখড়া, মহাখালী ও পল্টন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট চরমে। কিছু কিছু দোকানে বোতলজাত সয়াবিন মিললেও তা গায়ের দামের চেয়ে বেশি দরে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। নয়াবাজারের খুচরা মুদি দোকানে চাহিদার তুলনায় বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহে ঘাটতি দেখা গেছে। এছাড়া কাওরান বাজারেও একই অবস্থা।

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। এরপর নভেম্বরের শুরুতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৫ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা এবং খোলা সয়াবিন ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করে। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর এবং দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক-কর কমিয়ে তা ৫ শতাংশ কমানো হয়। এতে বাজারে সামান্য কমে ভোজ্যতেলের দাম। তবে নভেম্বরের শেষ নাগাদ বাজার থেকে উধাও হতে শুরু হয় ১, ২ ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, ৯ ডিসেম্বর লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। খোলা সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয় লিটারপ্রতি ১৫৭ এবং বোতলজাত ১৭৫ টাকা। তবুও সরবরাহ সংকট কাটেনি। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে নতুন বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এরপরও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট কাটেনি।

জানা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দূরীকরণে ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কমানোর পর বাজারে কিছুদিন সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। তবে কয়েক দিন ধরে ফের বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ কমেছে। দুয়েকটা কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন মিললেও তা পর্যাপ্ত নয়। আবার সেসব বোতলের গায়ের মূল্যের চেয়েও ২০ থেকে ২২ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, সংকট দেখিয়ে আসন্ন রমজানের আগে বোতলজাত সয়াবিনের দাম আরেক ধাপ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে এক, দুই ও পাঁচ লিটারের বোতলের সরবরাহ একেবারেই কম। তবে বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ আছে। কিন্তু বোতলজাত সয়াবিনের চেয়ে বেশি দামে খোলা তেল বিক্রি করা হচ্ছে।

শাহেদুল ইসলাম রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চায়ের দোকানদারি করেন। তার তিন সদস্যের সংসারে ঘরভাড়াসহ ও চাল-ডালের হিসাব মেটাতে গিয়েই হিমশিমে পড়েছেন। এরমধ্যেই বাজারে বাড়তি দামে সয়াবিন তেলের বোতল কিনতে হচ্ছে তাকে। বাজারে গতকাল সয়াবিন তেল কিনতে এসে শাহেদুল ইসলাম বলেন, বাজারে কয়েক দোকান ঘুরেও এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে দুই লিটারের বোতলই কিনেছি। শুধু ডেমরা মাতুয়াইল নয়, রাজধানীর অন্যান্য খুচরা বাজারেও বোতলজাত সয়াবিন তেল মিলছে না বললেই চলে। আর দুয়েক দোকানে মিললেও গায়ে লেখা দামের চেয়ে ২০ থেকে ২২ টাকা বেশি রাখছেন বিক্রেতারা।

মোহাম্মদীয়া ট্রেডার্স খুচরা দোকানি মাহমুদুল হাসান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘পাঁচ লিটারি বোতলজাত সয়াবিনের গায়ে ৮৫২ টাকা লেখা আছে, কিন্তু বিক্রি করছি ৮৭০ টাকায়। সংকটের কারণে ৮৫২ টাকা কিংবা ৮৫৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে, এখানে দামের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ডিলারের কাছ থেকেও সংগ্রহ করি, আবার খুচরা বাজার থেকেও সংগ্রহ করা হয়। সংকটে খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন সংগ্রহ করলে বাড়তি দামে কিনতে হয়। আর খোলা সয়াবিন ১৮০ টাকা লিটার বিক্রি করছি। আবার পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ভেঙে খুচরা বিক্রি করলে ৯৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ানোর জন্যই কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। রমজানের আগে আরেক ধাপ সয়াবিনের দাম বাড়বে। সয়াবিনের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা চলছে। ব্যবসায়ীরা যখন রাজনৈতিক সিন্ডিকেট চালায়, তখন সেখানে নীতিকথা বলে লাভ নেই। ব্যবসায়ীরা প্রতি সেকেন্ডে তার ব্যবসার লাভের আশা চিন্তা করবেন।’

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এক মাস ধরে আমার পরিবার বাজার থেকে খোলা সয়াবিন তেল কিনে খাচ্ছে। কারণ, খোলা ও বোতলজাত সয়াবিনের কোয়ালিটি (মান) একই। শুধু দামেই তফাত।’ সুপারশপ স্বপ্নকে খোলা তেল বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দেশে সয়াবিনের তুলনায় পাম অয়েল তেল আমদানি বেশি। পাম অয়েল সয়াবিন তেলের সঙ্গে মিশিয়ে তা সয়াবিন তেল বলে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে অজান্তেই মানুষের হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। সেজন্য সয়াবিন বলে পাম অয়েল বিক্রি বন্ধে ২০১৩ সালে আইন এবং ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিধিবিধান করেছিল সরকার। সেই আইন সম্পর্কে তিনি (বাণিজ্য উপদেষ্টা) জানেন না, অথচ তিনি পাম অয়েল নিয়ে কথা বলে দিলেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ী গ্রুপ থেকে আসায় তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছেন। ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বহু আশা করেছি, কিন্তু সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের জন্য ছাড় দিলেও তা ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছে না। ঢাকার বাইরে দুই লিটার বোতলজাত সয়াবিন পাওয়া যাচ্ছে না। গরমকালে পাম অয়েল সয়াবিন তেল হিসেবে বিক্রি করা হয়। বর্তমান সরকার কারো কাছে দায়-দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না। যদি মনে করতো তাহলে একটি পণ্যের দামও এভাবে বাড়তে পারে না।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত