ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ক্ষমতায় চোখ জামায়াতের

ক্ষমতায় চোখ জামায়াতের

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে ব্যস্ত সময় পার করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করাসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে দলটি। প্রতিদিনই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতারা। গত কয়েকদিনে ময়মনসিংহ, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জসহ কয়েক জেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক আসনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে দলটি। এতে স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াত ও ছাত্র সংগঠন শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা প্রার্থীদের ছবি দিয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। করছেন সমাবেশ। ওয়াজ মাহফিল করেও ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। জামায়াতে ইসলামী প্রতিটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণার আগে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে কয়েকটি টিমের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে জরিপও পরিচালনা করেছে।

সূত্রমতে, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই স্তরের প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে। জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা এরই মধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা বলেছেন। শতাধিক আসনে শক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় দলটি। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির ৫০টি, ‘বি’ ক্যাটাগরি ৫০টি আসনে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন কৌশলে এসব আসনে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে দলটি। অবশ্য নির্বাচনের আগে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য কিংবা জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাবে। তবে ‘এ’ ক্যাটাগরির কোনো আসন দলটি ছাড় দিতে রাজি হবে না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বিএনপির মতো জামায়াতে ইসলামীও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় বলে কেন্দ্রীয় নেতারা আভাস দিয়েছেন।

এদিকে সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা নিজ নিজ আসনে নানা কৌশলে গণসংযোগ ও প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নিয়মিত কর্মিসভায় যোগ দিচ্ছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। কর্মী ও রুকন সম্মেলনসহ দলের সাংগঠনিক সভাগুলোয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে সংগঠন গোছানোর কাজ। দলটির নেতাদের দাবি, এরই মধ্যে দেশজুড়ে জামায়াতের সাংগঠনিক ভিত অনেক শক্তিশালী হয়েছে। প্রকাশ্যে আন্দোলনের পাশাপাশি এখন ভার্চুয়াল কর্মকাণ্ডকেও ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রায় দিনই তারা বিভিন্ন বিভাগ, মহানগর ও জেলায় সাংগঠনিক বৈঠক ও দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। এরইমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারকাজ শুরু করার পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের তাদের এলাকায় তৃণমূল সমর্থন বৃদ্ধির জন্য মাঠে নামানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অধিকতর যোগ্য এবং জনমানুষের কাছে জনপ্রিয় নেতাদেরই প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন আসনে জরিপ পরিচালনার ভিত্তিতে দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সংসদীয় আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা শুরু করেছে। বেশকিছু জায়গায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এসব ছাত্রনেতা নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্নভাবে প্রচার কার্যক্রমও শুরু করেছেন।

জামায়াতের এক নেতা বলেছেন, তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ জামায়াতের নেতৃত্ব দেখতে চাচ্ছে, যা আমাদের উৎসাহিত করছে। প্রার্থীরা প্রতিটি গ্রামের ওয়ার্ড পর্যায়ে গণসংযোগ করবেন, সঙ্গে দলীয় লোকজনও কাজ করবেন। গ্রামের মানুষ যে ধরনের সমস্যায় জর্জরিত, সেই সমস্যাগুলো শুনতে পারবেন। মাঠে যত বেশি দৌড়াবে, মানুষের আগ্রহ তত বাড়বে। ফলে মানুষ খুব কাছে চলে আসবে। মানুষের স্বপ্ন জামায়াতে ইসলামী বাস্তবায়ন করতে পারবে। আবার যদি জোট হয়, তাহলে জাতীয় ঐক্যের জন্য যে কোনো আসন আমরা ছেড়ে দেব। জাতীয় স্বার্থে যে কোনো ত্যাগ করতে জামায়াতে ইসলামী প্রস্তুত থাকবে।

সূত্রমতে, নির্বাচন কমিশনে জামায়াত এখনো নিবন্ধন ফিরে পায়নি। তাদের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। নিবন্ধন ও দাঁড়িপাল্লা ফিরে পেতে তাদের আইনি লড়াই অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা জানান, ‘নিবন্ধনের বিষয়ে খুব শিগগিরই শুনানি হতে পারে।’ এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগীয় সম্পাদক ও মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী দাড়িপাল্লা প্রতীকসহ দলের নিবন্ধন পেয়েছিল। এ কারণে যখন ফের নিবন্ধন ফিরে পাবে তখন দাড়িপাল্লা প্রতীকসহই পাবে। এর বত্যয়ের সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৭৬টি আসনে প্রার্থী দিলেও ১০টি আসনে জয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ২২২টি আসনে প্রার্থী দিলেও ১৮টি আসনে জয়ী হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নীলফামারী-৩, সাতক্ষীরা-২ ও পিরোজপুর-১ আসনসহ মোট তিনটি আসনে জয়ী হয় জামায়াত। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে ১৭টি আসনে জয় ও ৪টি সংরক্ষিত নারী আসন পায় দলটি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে জয়ী হয়। ওই নির্বাচনে দলটি জোটগতভাবে ৩৯টি এবং ৪টিতে এককভাবে নির্বাচন করে। তবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে ২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল জামায়াত।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা বিভেদের বাংলাদেশ চাই না। মানবিক ও সাম্যের বাংলাদেশ চাই। সেই বাংলাদেশ গড়তে দেশবাসীর ভালোবাসা চাই, সহযোগিতা চাই। তাদের পাশে চাই। আমরা কথা দিচ্ছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে যুবকদের দেশ গড়ার কারিগর বানাবো। নারীদের যথাযোগ্য সম্মান দিবো। এই দেশে আর কোনো ষড়যন্ত্র হতে দিব না। জীবন দিব তবুও কারো লালচক্ষু দেখাতে দিব না।

দেশবাসীর উদ্দেশে আমীর বলেন, আমরা এমন একটা দেশ চাই, যেখানে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন চাই না। টুকরা টুকরা জাতি চাই না। আমরা মাইনরিটি মেজরিটি শব্দই শুনতে চাই না। এখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরাও বলেছে এই কথাগুলো বলেই আমাদের শোষণ করা হয়েছে। আমরাও চাই না। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই দেশকে গড়ে তুলবো। নারীদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া হবে। তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। তারা নিরাপদভাবেই ঘরে থাকবেন, বাইরে যাবেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন। যুবকদের হাত কাজের হাতে পরিণত করবো। সেই অপেক্ষায় আছি। আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ বলছেন যে, জীবন দিবো দেশের সার্বভৌমত্ব দিবো না। কারো লাল চোখের দিকে আর আমরা তাকাব না। আমাদের দিকে যদি কেউ লাল চোখ তুলে তাকায় তাও আমরা বরদাস্ত করব না। আমরা পিন্ডির হাত থেকে মুক্ত হয়েছি অন্য কারো হাতে বন্দি হওয়ার জন্য নয়। বরং সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সেই বৈষম্যহীন মানবিক সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে চায়। এজন্য আপনাদের ভালোবাসা দরকার, দোয়া চাই, সহযোগিতা চাই, ইতিবাচক সমালোচনাও চাই। আমরা বিভেদহীন জাতি চাই। আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি নিয়ে সামনে এগুতে চাই।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ৫ আগস্টের বিজয়কে অক্ষুণ্ণ রাখতে আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়া বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না সাধারণ মানুষ। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করবে। সম্প্রতি এক মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আরো বলেন, জামায়াতে ইসলামী পূর্বে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল। সবশেষ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ২০২২ সালে জোট ভেঙে যায়। তবে ইসলামী দলসহ অন্যান্য সমমনা দলের সঙ্গে জোট করতে জামায়াতে ইসলামীর কোনো আপত্তি নেই। যাদের সঙ্গে জোট করা হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রয়োজনে তাদের কিছু কিছু আসন আমরা ছেড়ে দেব। কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকারের নৈরাজ্যবাদ থেকে মুক্তির জন্য জামায়াতে ইসলামী সব সময় সোচ্চার থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করে যেতে ঐক্যবদ্ধ।

দেশের মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় বলে দাবি করে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুয়াযয্ম হোসাইন হেলাল বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ নতুন রাষ্ট্র চায়, পুরাতন দিনের গান আর কেউ শুনতে চায় না। দেশ পরিচালনার জন্য দেশের মানুষ নতুন নেতৃত্ব দেখতে চায়। তিনি আরো বলেন, ১৯৪১ সালে ৭৫ জনকে নিয়ে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকে বাংলাদেশে তিন থেকে চার কোটি মানুষ সরাসরি এ আন্দোলনের সাথে জড়িত। নেতৃবৃন্দের উপর গত ১৭ বছরে শত নির্যাতনের পরেও দেশের মানুষের পাশে আছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অন্যদের মতো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। এজন্য দেশের মানুষের আস্থার জায়গায় জামায়াতে ইসলামী।

জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেছেন, দীর্ঘদিনের স্বৈরচারী দুঃশাসনের পর দেশের মানুষ এখন শান্তি চায়, স্বস্তি চায়। তারা জামায়াত ইসলামকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। কারণ মানুষ জানে, জামায়াতই পারবে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। শামসুল ইসলাম আরো বলেন, আওয়ামী স্বৈরাচার ১৫ বছর জনগণের ওপর চেপে বসেছিল; কিন্তু আল্লাহর রহমত যখন আসে তখন শয়তানি শক্তি পালাতে বাধ্য হয়। ন্যায়ের জন্য যারা লড়াই করে তাদের বিজয় নিশ্চিত। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখন আমরা আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গঠন করতে চাই।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল বলেছেন, দেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে পেতে হলে সৎ, দুর্নীতিমুক্ত এবং জনগণের অধিকার আদায়ের সচেষ্ট একটি সরকার প্রয়োজন, আমাদের দল সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে সাধারণ মানুষকে সহায়তার জন্য কোথাও যেতে হবে না। সরকার তার নিজ দায়িত্বেই সব মানুষের বাড়ি বাড়ি সহায়তা পৌঁছে দেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত