স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতন ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেশজুড়ে চলমান আছে। এরমধ্যেই গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে শিক্ষার্থীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীরা হামলা করা হয়েছে। ওই বাড়ির আশপাশে লুকিয়ে থাকা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল, সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাসেল ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের অনুগতরা পরিকল্পিতভাবে দা, বঁটিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ওই হামলায় অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন, একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জানা গেছে, আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে শুক্রবার রাতেই হাসপাতালে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম। গতকাল শনিবার গাজীপুরে ডিসি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন দুই সমন্বয়ক। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়াও গতকাল বিকাল পর্যন্ত হামলাকারী ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের উপরে হামলার রেষ কাটার আগেই গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। গাজীপুর শহরের জোর পুকুরপাড়ের দিক থেকে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করে পালিয়ে যায়। গুলিতে মোবাশ্বের হোসেন (২৬) নামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় এক সদস্য আহত হয়েছেন। তিনি গাজীপুর মহানগরের হারিনাল দক্ষিণপাড়া এলাকার আলী আহমেদের ছেলে। তাকে উদ্ধার করে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, গত শুক্রবার রাতের হামলার ঘটনায় বিচারের দাবিতে শনিবার শহরের রাজবাড়ি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান শিক্ষার্থীদের বিচার নিশ্চিত ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে পাঁচটার দিকে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুর করেন। আহত মোবাশ্বের হোসেন বলেন, তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন। তখন শহরের জোর পুকুরপাড়ের দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে দুর্বৃত্তরা এসে হঠাৎ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। গুলিটি তার ডান হাতের এক পাশে লাগায় তিনি বেঁচে যান। পরে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মো. মনজুর মোর্শেদ বলেন, রোগীর ডান বাহুতে গুলি লেগেছে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সার্জারি বিভাগে ভর্তি রাখা হয়েছে।
গাজীপুর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, একজন ছাত্রের হাতে গুলি লেগেছে বলে শুনেছেন। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার হাতে গুলি লেগেছে। ঘটনাটি পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
মারধরে আহত সাতজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান জানান, গাজীপুর থেকে মারধরে আহত হয়ে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে মোট ১১ জন এসেছিলেন। তাদের মধ্যে চারজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। বাকি সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত সাতজনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। তার নাম কাশেম (১৭)। বাকি ছয়জনকে দুয়েক দিনের মধ্যে ছাড়পত্র দেয়া হবে। ঢাকা মেডিকেলে বাকি যে ছয়জন চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা হলেন, ইয়াকুব, শুভ শাহরিয়ার, গৌরভ ঘোষ, আবদুর রহমান ইমন, সাব্বির খান হিমেল ও কাজী ওমর হামজা।
হাসপাতালে হামলায় আহত ইয়াকুবের ভাই মো. নাছির বলেন, ফাঁদে ফেলে তার ভাইসহ অন্যদের গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসার একটি কক্ষে গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে আটকে রেখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। তাদের এলোপাতাড়ি আঘাত করা হয়। তার ভাইয়ের মাথায় আঘাত রয়েছে। তার ভাইসহ কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) আহতদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের সামনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, গাজীপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের সর্বোচ্চ বিচারের আওতায় আনা হবে।
গাজীপুর জেলা শহরের রাজবাড়ী সড়কে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, খুনি হাসিনার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো গাজীপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সন্ত্রাসীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের যোদ্ধাদের হুমকি দিচ্ছে। এসময় অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেন, এই সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ইন্টেলিজেন্স যদি আজকে রাতের মধ্যেই হামলায় জড়িত খুনি-সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে না পারে, তাহলে আমাদের তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। কোথাও আমাদের কোনো সহযোদ্ধার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা হলে পুরো বাংলাদেশ আবার নতুন করে জেগে উঠবে। আমরা প্রয়োজনে যেমন ঢাকায় নামতে পারি, তেমনই গাজীপুরে আসতে পারি। প্রয়োজনে দেশের প্রত্যেক জেলায় জেলায় যেতে পারি। অভ্যুত্থানে দেখিয়েছি, এ দেশের ছাত্র-জনতা সঠিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ধৈর্য ধরেছে। কিন্তু একটা ধৈর্যের বাঁধ আছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে যারা কাজ করছে, তারা যদি আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয় তাহলে দেশে নতুন আরেকটি বিপ্লব দেখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করীম খান বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সময়মতো পুলিশ ঘটনাস্থলে যেতে না পারার কারণে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি সদর ওসিকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেন।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গাজীপুরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাকর্মীরা। শনিবার দুপুর ১২টায় গাজীপুর জেলা শহরের রাজবাড়ী মাঠে জাতীয় নাগরিক কমিটির গাজীপুর জেলা ও মহানগর শাখার আয়োজনে এ বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরে ছাত্ররা জেলা শহরে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সংগঠক আলী নাসের খান, কেন্দ্রীয় সদস্য এম সোয়েব, গাজীপুর মহানগরের গাছা থানা প্রতিনিধি আনিসুর রহমান, টঙ্গী পশ্চিম থানা প্রতিনিধি নাবিল ইউসুফ প্রমুখ।
আলী নাসের খান বলেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে দ্রুত বিচার আইনে ফ্যাসিবাদীদের বিচার করতে হবে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পদ জব্দ করতে হবে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের অপসারণের দাবি তোলা হয়। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বাড়িতে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। তারা ছাত্রদের ট্রাপে ফেলে হামলা করেছে। গাজীপুর থেকেই ফ্যাসিবাদের মূল উপড়ে ফেলার কার্যক্রম শুরু হবে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর জাহাঙ্গীর আলমের লোকজন হামলা করেছেন। আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়ি ভাঙচুরের অজুহাতে ছাত্রদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ এভাবে হামলা করতে পারে না। হাসিনার প্রেতাত্মারা ভারতে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তাদের সব ধরনের ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।