পশ্চিমতীরের উত্তরাঞ্চলে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। গত শুক্রবার রাতে এবং গতকাল শনিবার সকালে দখলদার সেনাদের ওপর বেশ কয়েক দফা হামলার খবর দিয়েছে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো। আল-কাসসাম ব্রিগেডসের তুলকারম ব্রিগেড জানিয়েছে, তুলকারমের দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার দিয়ে আঘাত হেনেছেন তাদের যোদ্ধারা। শুক্রবার গভীর রাতে আল-কুদস ব্রিগেডস এবং আল-আকসা মার্টারস ব্রিগেডসের সঙ্গে যৌথভাবে এই হামলা পরিচালিত হয়। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা নিশ্চিতভাবে নিহত হন বলে টেলিগ্রাম চ্যানেলে জানিয়েছে আল-কাসসাম। আল-আকসা মার্টারস ব্রিগেডসের যোদ্ধারাও ইসরায়েল-অধিকৃত তুলকারম চেকপয়েন্টের পাশে ইসরায়েলের এক পদাতিক বাহিনীকে এবং শহরের পূর্বদিকের প্রবেশপথে আরেক বাহিনীর ওপর আঘাত হানেন। জেনিন শরণার্থী শিবির থেকেও প্রচণ্ড লড়াইয়ের খবর এসেছে, যেখানে পশ্চিমতীরের বিভিন্ন স্থানের মতো বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। বাড়ি-বাড়ি হানা দেয়া হচ্ছে, সম্পদ লুটতরাজ হচ্ছে ও ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আল-মায়াদিন বলেছে, শনিবার সকালে নাবলুসের পূর্বাঞ্চলীয় একটি গ্রাম, জেনিনের পশ্চিমে ইয়াবুদ শহর ও তুলকারমের শারকা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালায়। সেখানে প্রতিরোধ যোদ্ধারাও দখলদার সেনাদের হটাতে প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার মার্কিন পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ। তারা বলেছেন, এটি মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রতি চরম হুমকি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদি মানসিকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, এটি সেই বিপর্যয়ের ইতিহাসের পুনর্লিখন, যেখানে আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের জোর করে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করা হচ্ছে। হিজবুল্লাহর বলেছে, কিন্তু এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ যুদ্ধমেশিন নিরলস আগ্রাসন চালিয়েও ফিলিস্তিনি জনগণের মনোবল ভাঙতে পারেনি। গাজার প্রতিরোধ সংগ্রামকে স্বাগত জানিয়ে লেবানিজ সংগঠনটি বলেছে, গাজাবাসীর অতুলনীয় এই দৃঢ়তা মহাকাব্যিক। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ কিংবা নির্বাসিত করার পরিকল্পনাকেও ব্যর্থ করে দেবেন তারা। বিবৃতিতে বলা হয়, গাজাবাসীর জীবনমান উন্নত করার প্রতারণামূলক স্লোগান তাদের কানে যাবে না। কারণ, এরকম বহু ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হতে ইস্পাতকঠিন মনোবল তৈরি হয়েছে ফিলিস্তিনিদের। গাজাবাসীর পক্ষে লেবাননের জনগণের দৃঢ় অবস্থান অটুট থাকবে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়।
ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার উপকূলীয় পর্যটনশিল্প তথা হোটেল-রেস্টুরেন্ট তারাই গড়ে তুলতে পারবেন এবং গাজা পুনর্নির্মাণ করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একইসঙ্গে তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে তিনি গাজাকে জনশূন্য করে বিলাসবহুল নগরী বানানোর কথা বলেছেন। ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে আসাদ আবু হাসেইরা নামে গাজার এক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেছেন, ‘সব কিছুই আমরা পুনর্নির্মাণ করতে পারব।’ পুনর্নির্মাণের আগেই তিনি তার রেস্তোরাঁ থেকে খাবার পরিবেশন শুরু করবেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প বলছেন, তিনি গাজার রেস্তোরাঁ বদলাতে চান, গাজাকে বদলাতে চান এবং গাজার জন্য নতুন ইতিহাস তৈরি করতে চান। কিন্তু আমরা আরব ঐতিহ্য নিয়েই থাকব এবং আরবদের ইতিহাস কখনও বিদেশিদের ইতিহাস দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে না।’ গাজার এই বাসিন্দা প্রশ্ন তোলেন, ‘হোটেল-রেস্তোরাঁ তো এখানে ছিলই! ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র মিলে এগুলো ধ্বংস করল কেন? এখন নতুন করে এসব তৈরি করার দরকার হচ্ছে কেন?’ খবরে বলা হয়, গাজাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করে সেখানে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র বানানোর পরিকল্পনা মূলত ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের পুরোনো প্রস্তাবেরই পুনরাবৃত্তি। এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পরিকল্পনা বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে পড়েছে। বলা হচ্ছে, এটি ‘জাতিগত নির্মূলের’ শামিল এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। গাজাবাসীও এই পরিকল্পনা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছে, নিজেদের ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে তারা কখনও অন্য কোথাও যাবেন না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বাসিন্দাদের মিসরে পুনর্বাসন করার মার্কিন প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস। শুক্রবার জার্মান শহর লুডভিগসবুর্গে এক প্রচারণায় ট্রাম্পের প্রস্তাবকে পুরোপুরি খারিজ করে দেন তিনি। জার্মানির চ্যান্সেলর বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই গাজার বাসিন্দাদের মিসরে পুনর্বাসন করতে পারি না।’ ওলাফ শলৎস আরো বলেন, আগামীতে মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো ধরনের সংঘাত এড়ানো এবং ইসরায়েল ও ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার কথা বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নিতে হবে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প গাজার মালিকানা নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
আরব দেশগুলো এই প্রস্তাব কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ট্রাম্পের মন্তব্য ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পরিকল্পনা।
এদিকে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত মেনে শনিবার গাজায় থাকা আরো তিন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। তারা হলেন- ৫২ বছর বয়সি এলি শারাবি, ৫৬ বছর বয়সি ওহাদ বেন আমি এবং ৩৪ বছরের ওর লেভি। তারা সবাই বেসামরিক ব্যক্তি। এর বিপরীতে ইসরায়েলি কারাগারগুলো থেকে ১৮৩ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। গত ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।