ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতার মূলমন্ত্র

ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতার মূলমন্ত্র

পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাঙালিরাই ভাষার জন্য, মায়ের মুখের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলন করেছে। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে কালো পিচঢালা রাস্তাকে রঞ্জিত করেছে। অস্ত্রের মুখে বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। ১৯৫২ সাল। বাঙালি এবং বাংলাদেশিদের জন্য একটি গৌরবময় সাল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পুরো সালটিকে অর্থাৎ পুরো বছরটিকে একটি পরিপূর্ণ ইতিহাসে রূপান্তরিত করে। যা আমাদের বীরত্বের কথা বিশ্ববাসীকে জানান দেয়। কীভাবে একটি নিরস্ত্র জাতি শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিল। নিজের মায়ের মুখের ভাষাকে আগলে রাখতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ বির্সজন দিতে কুণ্ঠাবোধ করল না। মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় বাঙালিদের জয় নিশ্চিত হলো। দাবি আদায় হলো। পৃথিবীকে জানান দিল একটি সঠিক আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিজেদের ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় করে রাখা যায়। নিজেদের চেতনার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে অসাধ্যকে সাধন করা যায়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে চেতনাই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করে। ১৯৫২ মালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ আমাদের বীর সন্তানরা রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষাকে আগলে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে। তাদের অস্ত্র আর বুলেটের জোর থেকে ভাষা আন্দোলনকারীদের মনের জোর ছিল অনেক বেশি। তাই অস্ত্র হাতে নির্বিচারে গুলি করেও ভাষা আন্দোলন দমাতে পারেনি। অবশেষে আমাদের দাবি মেনে নেয় এবং আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষাকে তারা জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেয়। কালক্রমে এই ভাষা আন্দোলনের সফলতা থেকে স্বাধীনতার চেতনায় রূপ নেয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের অধিকার লাভ করি। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন ‘উর্দুকে’ পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করলে পূর্ববঙ্গ থেকে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে আবুল কাশেমের নেতৃত্বাধীন তমদ্দুন মজলিশ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আবার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে শুরু হয়। আস্তে আস্তে সারা পূর্বপাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশে তুমুল আন্দোলন শুরু হলে কেন্দ্রীয় সরকার আন্দোলন থামানোর জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করলে পুলিশ তাতে গুলি ছুড়ে আন্দোলনকারীদের অনেকেই মারা যান। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে বাঙালিদের দাবি মেনে পাকিস্তানের সরকার প্রণীত সংবিধানে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীন সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি অধিকার আদায়ের জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রেরণা লাভ ও শতন্ত্র জাতি হিসেবে একটি শতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ এবং স্বাধীন সার্বভৌমত্বের অধিকার করতে সক্ষম হতে পারা। মোট কথা ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতি অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় আন্দোলন করার অনুপ্রেরণা জোগায়। যা প্রত্যেক আন্দোলনই মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত