ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সি-ট্রাকে পিষ্ট নৌপথের মাফিয়া চক্র, উচ্ছ্বাস

বহুল প্রত্যাশিত সি-ট্রাকের উদ্বোধন
সি-ট্রাকে পিষ্ট নৌপথের মাফিয়া চক্র, উচ্ছ্বাস

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নৌ-ঘাটের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালীর মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজার-মহেশখালী নৌরুটে বহুপ্রত্যাশিত সি-ট্রাকের বাণিজ্যিকভাবে উদ্বোধনের খবরে মহেশখালীর ঘরে ঘরে আনন্দের জোয়ার বইছে। এছাড়া এতে করে কমেছে নৌপথে মানুষের চলাচলের ঝুঁকি। বলা হচ্ছে, অনেকটা ঘাট সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্তি মিলেছে দ্বীপবাসীর। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পর্যটন মৌসুমে আদিনাথ মন্দিরসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বাড়বে পর্যটকদের আগমন। এতে করে রাজস্ব পাবে সরকার। দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর বাসিন্দা চার লাখ। চিকিৎসা, আদালত ও জেলা প্রশাসনের কার্যক্রমসহ অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি সেবা নিতে সাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার জেলা সদরে যেতে হয় এসব বাসিন্দাদের। এর মধ্যে গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অধিগ্রহণকৃত জমির টাকা উত্তোলন এবং এই সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার প্রয়োজনে একটি বড় সংখ্যক বাসিন্দাকে প্রায় প্রতিদিন কক্সবাজার সদরে যেতে হয়। কিন্তু এই যাতায়াতে নৌ-ঘাটের যন্ত্রণায় এক সীমাহীন দুঃখ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই দ্বীপের বাসিন্দাদের।

এতকাল বোটের জন্য জেটিতে দীর্ঘ অপেক্ষা, বোটে উঠতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, রোগী পারাপারে প্রতিবন্ধকতা, নড়বড়ে জেটি, নাব্য সংকট, ঘাট কর্তৃপক্ষ ও বোট চালকদের হাতে লাঞ্ছনা, ঝড়-বৃষ্টিতে ভোগান্তি এবং জেটিতে রিকশাচালকদের দৌরাত্ম্যে মহেশখালীর মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে এরশাদের সরকারের আমলে ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৩ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের মহেশখালী ঘাটের জেটি নির্মাণ করা হয়। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ২০০০ সালে ১০০ মিটারের আরেকটি নতুন জেটির সম্প্রসারণ করা। কিন্তু পলি জমে খাল ভরাট হতে থাকায় ভাটার সময় নৌযানে ওঠানামায় চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এরপর আর কোনো স্বস্তিদায়ক ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। তাই প্রায় ২৫ বছর ধরে ভাটায় কাদা মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে দুই বা তিনবার পলি ড্রেজিং করা হয়। তাও এক মৌসুম শেষ না হতেই ভরাট হয়ে যায়। এটিই জেটি পারাপারে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগের কারণ যাত্রীদের। ঘাট কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেছে, গত মৌসুমে মহেশখালী জেটিঘাট সংলগ্ন খাল খনন করা হয়েছিল। কিন্তু গত বর্ষায় পলি জমে তা আবার ভরাট হয়ে গেছে। এতে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে তীব্র নাব্য সংকট সৃৃষ্টি হয়েছে। তাই ভাটার সময় ঘাটে ভিড়তে পারছে না স্পিডবোটসহ সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান। তাই মূল নদীতেই নেমে ডিঙি নৌকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয়। বর্তমান শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় পূর্ণ ভাটায় ডিঙি নৌকাও চলছে না; তাই হাঁটু বা তারও বেশি কাদা মাড়িয়ে উঠতে হচ্ছে কূলে। অন্যদিকে নাব্য সংকটে ৬ নম্বর ঘাটেও ভিড়তে না পেরে নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএর ঘাটে ভিড়ছে নৌযানগুলো। একইভাবে আদিনাথ জেটিও নাব্য সংকট ও জরাজীর্ণতায় যাত্রী পারাপারে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে রোগী, নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঘাটের এই সীমাহীন দুর্ভোগ লাঘবে প্রায় সময় নানা আন্দোলন ও প্রতিবাদ হয়। অবশেষে মহেশখালী নৌ-ঘাটে সি-ট্রাক চালু হলো। কক্সবাজার শহরে বসবাসরত, মহেশখালীর বাসিন্দা শাহেদ মিজান বলেন, ‘সি-ট্রাক চালু হওয়ায় মহেশখালীর জনসাধারণের জীবনমান আরও সহজ ও উন্নত হবে।’ জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজের ফলে চিরকালীন বহু দুর্ভোগ-হয়রানি কমে যাবে। এতে সার্বিক ক্ষেত্রে উন্নতি হবে। অন্যদিকে আদিনাথসহ মহেশখালী ভ্রমণে পর্যটকদের জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

মহেশখালী-কক্সবাজার নৌরুটে দ্বীপবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত সি-ট্রাক সার্ভিসের উদ্বোধন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএর ঘাট থেকে ফিতা এবং বেলুন উড়িয়ে সি-ট্রাক সার্ভিসের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক সাহিত্যিক মহেশখালীর সন্তান অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান।

নৌপরিবহন উপদেষ্টার ঘোষণার মাধ্যমে এই নৌরুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। মহেশখালী থেকে কক্সবাজার ৬নং ঘাটে জনপ্রতি ৩৫ টাকা এবং মহেশখালী থেকে কক্সবাজার নুনিয়ারছড়া ঘাটে ৩০ টাকা করা হয়েছে । একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারবেন ২৫০ জন যাত্রী। ফলে এই রুটের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি কমবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসময় সি-ট্রাকে চড়ে মহেশখালী যান অতিথিরা। সি-ট্রাক মহেশখালী পৌঁছানোর পর বিআইডব্লিউটিএ জেটিতে মহেশখালীর ইউএনও মো. হেদায়েত উল্যাহর পরিচালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন নৌ-উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। এছাড়া অতিথি ছিলেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা, বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান মো. সলিমুল্লাহ, বিআইডব্লিউটিএ সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালনা) মো. জিয়াউল ইসলাম, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, পুলিশ সুপার মো. সাইফ উদ্দিন শাহীন, বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর) একেএম আরিফ উদ্দিন, বিআইডব্লিউটিএ প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার ও বিআইডব্লিউটিএ কক্সবাজার (কস্তুরাঘাট) নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক মো. খায়রুজ্জামান।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে রাজনৈতিক মাফিয়া চক্রের হাতে দ্বীপের বাসিন্দারা জিম্মি ছিলেন। ওই মাফিয়া চক্রের কারণে এই সেবা এত দিন চালু হয়নি। এখন থেকে দ্বীপের বাসিন্দারা নিরাপদে সি-ট্রাকে করে যাতায়াত করতে পারবেন। রাতেও যাতে দ্বীপের বাসিন্দারা সি-ট্রাকে করে যাতায়াত করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হবে।

উপদেষ্টা আরও বলেন, দ্বীপের বাসিন্দারা যাতে কক্সবাজার ৬ নম্বর জেটিঘাট দিয়ে যাতায়াত করতে পারেন, তার জন্য ড্রেজিং করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মামলার কারণে ড্রেজিং কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত ৬ নম্বর ঘাট ড্রেজিং করা হবে, যাতে দ্বীপের বাসিন্দারা সরাসরি কক্সবাজার ৬ নম্বর ঘাট দিয়ে যাতায়াত করতে পারেন।

ড. সলিমুল্লাহ খান তার বক্তব্যে বলেন, দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের যদি উন্নয়ন না হয় তাহলে ঢাকায় আমাদের মেট্রোরেলে চড়ে কোনো লাভ নেই।

আমরা উন্নয়ন করতে চাই কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে যে মামলা দায়ের করা হয় সে কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মহেশখালীর তরুণ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সব বাধা ডিঙাতে পারবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি বলেন, মহেশখালীতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে, মাতারবাড়িতে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু কক্সবাজার-মহেশখালী নৌরুটে গেল ২০ বছরে কোনো উন্নয়ন হয়নি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে মহেশখলীবাসীর জন্য।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত