জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় প্রাণহানির ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনার তৃতীয় দিনের মাথায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দিয়েছে এনডিটিভি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতীয় চৌকি লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনুমাননির্ভর গুলির পাল্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছে। সামরিক সূত্র বলছে, নিরাপত্তা বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ‘কার্যকর জবাব’ দিয়েছে এবং কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও ইসলামাবাদ এই দাবি তীব্রভাবে অস্বীকার করে এবং ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ হিসেবেও অভিহিত করেছে। হামলার পরদিন প্রতিবেশী দেশটির নাগরিকদের ভিসা বাতিল ও সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় ভারত। ভারতের পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানও কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতীয়দের ভিসা বাতিল, দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত, ভারতের বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পালটা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। পালটাপালটি এসব পদক্ষেপে দেশ দুটির মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে যা হয়তো সামরিক সংঘাতে গড়াতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলার কয়েকদিন পর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ‘জঙ্গি দমনে’র নামে একের পর এক মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তল্লাশি ও অভিযান শুরু করে। যা এখনও বিভিন্ন এলাকায় অব্যাহত রয়েছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয় শুক্রবার কাশ্মীরের বান্দিপোরায় ‘কথিত’ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার শীর্ষ কমান্ডার আলতাফ লাল্লিকে হত্যা করে। সকাল থেকেই কুলনার বাজিপোরা এলাকায় তল্লাশি অভিযান শুরু করে। এ সময় কথিত ওই সংগঠনের সদস্যরা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়, এ সময় পালটা জবাব দেয় সেনারা। এতে ‘লস্কর জঙ্গি কমান্ডার’ আলতাফ নিহত হন। তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া পেহেলগাম হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আসিফ শেখ নামের আরেক মুসলিম নাগরিকের বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে ভারতীয় বাহিনী।
হিন্দুস্তান টাইমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- মোগামায় তার বাড়িতে তল্লাশি করার সময় একটি সন্দেহজনক বাক্স পাওয়া যায়, যা একটি বোমার অংশ ছিল। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেটি নিষ্ক্রিয় করে দেয়। অপরদিকে, পেহেলগাম হামলায় জড়িত সন্দেহে দুই বিদ্রোহীরা বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে ভারত। সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি দাবি করেছে, আদিল হুসেইন এবং আসিফ শেখ নামে এ দুজন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। বৃহস্পতিবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরে আলাদা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়। আদিল হুসেইন সেখানকার অনন্তনাগ বিভাগের স্থানীয় বাসিন্দা। পেহেলগামে যে হামলা হয়েছে সেখানে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে দাবি করছে ভারত। অপরদিকে আসিফ শেখ এ হামলা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে দাবি তাদের।
এদিকে কাশ্মীর হামলায় নিরাপত্তার গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পর্যটকদের ওপরে এই হামলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মতোই ক্ষেপে উঠেছেন কাশ্মীরিরাও কারণ এই পর্যটকরাই যে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের রুজি-রুটির অংশ! সামাজিকমাধ্যমে ভারতের মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, তবে একইসঙ্গে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, যে হামলার সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিল!
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে প্রায় ২০ মিনিট হামলা চলার পরে যখন নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে পৌঁছায়, ততক্ষণে বন্দুকধারীরা পালিয়ে গেছে। ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এই একই তথ্য উঠে এসেছে। মহারাষ্ট্রের পুণের বাসিন্দা মিজ আশাবরী সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি তার বাবা-মা ও আত্মীয়দের সঙ্গে ছিলেন। ওই হামলায় তার বাবা ও এক আত্মীয় নিহত হয়েছেন। পিটিআই মিজ আশাবরীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, ‘আমাদের সাহায্য করার জন্য সেখানে কেউ ছিল না। আমাদের যে খচ্চর-চালকরা আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই একমাত্র আমাদের সাহায্য করেছিলেন।’
তিনি দাবি করেন, হামলার ২০ মিনিট পর নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেজেএস ধিলোঁ ভারতীয় সেনাবাহিনীর শ্রীনগরভিত্তিক ১৫ কোরের প্রাক্তন কম্যান্ডার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপাতত আমি এটাই বলব, হ্যাঁ, কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গতিশীল বা ডায়নামিক পদ্ধতিতে কাজ করে। সেটার নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখেছি, বৈসরন উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো উপস্থিতি ছিল না। যে এলাকায় এত পর্যটকদের ভিড়, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী থাকা উচিত ছিল।’
নিরাপত্তাব্যবস্থায় ত্রুটির কথা স্বীকার করেছে ভারত। বৃহস্পতিবার রুদ্ধদ্বার সর্বদলীয় বৈঠকে ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধীদের কাছে নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি স্বীকার করেছে। সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে ইন্ডিয়া টুডে। বৈঠকেবিরোধী দলগুলোর একাধিক নেতা নিরাপত্তাব্যবস্থার দৃশ্যমান ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যা মেনে নেয় মোদি সরকার।
সূত্র বলছে, বৈঠকে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বিরোধীদলের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যদি কিছুই ভুল না হয়, তাহলে আমরা এখানে বসেছি কেন? কোথাও না কোথাও ত্রুটি হয়েছেই, আর সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’ সরকারের কাছে তারা জানতে চান, ‘কোথায় ছিল নিরাপত্তা বাহিনী? সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ বাহিনী কোথায় ছিল?’ এর জবাবে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা বলেছেন, অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামের কাছে বৈসরণ এলাকাটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার আগে স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে কিছু জানায়নি। সাধারণত, জুনের অমরনাথ যাত্রা পর্যন্ত বৈসরণে যাতায়াতে বিধিনিষেধ থাকে। ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে দেরিতে পৌঁছানোর নিয়েও বৈঠকে উদ্বেগ জানানো হয়।
প্রত্যুত্তরে সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ঘটনাস্থলটি এমন জায়গায় যেখানে পৌঁছাতে উঁচু পাহাড়ি পথে ৪৫ মিনিট হেঁটে যেতে হয় এবং এই ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো প্রস্তুতিও ছিল না। বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু সাংবাদিকদের জানান, ভারতকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালাতে হবে- এ ব্যাপারে সব দল একমত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই লড়াইয়ে সরকারের সঙ্গে আছে বলে জানিয়েছে সব দল। সরকার যে পদক্ষেপই নিক না কেন, তাতে তারা সমর্থন দেবে বলে সব দল এবং তাদের নেতারা এক সুরে জানিয়েছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈঠকটি শেষ হয়েছে।’ লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সবাই পেহেলগামে হামলার নিন্দা জানিয়েছে। যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বিরোধীরা।’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সভাপতিত্বে এ সর্বদলীয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু, রাজ্যসভার নেতা জেপি নড্ডা, রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গ,ে লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুলসহ আম আদমি, তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি, এনসিপি, শিবসেনা, এসপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও কাশ্মীরের এই হামলাকে ‘সাজানো’ ঘটনা বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। অবশ্য এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ সামনে আনেনি দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই দেশটি। শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পর্যটক হত্যাকাণ্ড ছিল ‘পরিকল্পিত একটি ঘটনা’। তার ভাষায়, ‘আমরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সন্দেহ করি, এটি একটি ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন অর্থাৎ নিজেরাই ঘটিয়ে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা’। তবে তিনি এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। আসিফ আরও বলেন, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সক্রিয় কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো ধরনের সংযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরে যা ঘটছে বা কাশ্মীরি কোনো আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা একেবারেই কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত নই।’ পাকিস্তানের এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারত সরকারের দাবি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ভারত সরকার যে অভিযোগ করছে, আমি তা জোরালোভাবে নাকচ করছি।’ এর আগে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার দেশটি একটি বেসরকারি চ্যানেলে বলেন, ‘ভারতের নেওয়া পদক্ষেপগুলো শিশুসুলভ এবং এতে গুরুত্বের অভাব রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত প্রতিটি ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং অতীতের মতো এবারও পাকিস্তানকে দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এই জবাব কম হবে না।’
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তিনি বলেছেন, পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে পূর্ণ মাত্রার সংঘাতের আশঙ্কা নিয়ে বিশ্বকে ভাবতে হবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরে চালানো ওই হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন নেপালি নাগরিকও রয়েছে। ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। যদিও এই দাবি ইসলামাবাদ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে এবং এটিকে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন হিসেবেও অভিহিত করেছে। খাজা আসিফ জোর দিয়ে বলেছেন, ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। ভারত যা কিছু শুরু করবে তার প্রতি আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখাব। যদি কোনো সর্বাত্মক আক্রমণ বা এই জাতীয় কিছু হয়, তাহলে অবশ্যই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে। তবে, তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে পরিস্থিতি এখনও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত কি না, জানতে চাইলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতিবাচক উত্তর দেন। বলেন, দুইটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘর্ষ সর্বদা উদ্বেগজনক। যদি পরিস্থিতি সেই রকম কিছু হয়, তাহলে দুঃখজনক পরিণতি আসতে পারে।
এদিকে ভারতকে ‘চূড়ান্ত জবাব’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আজাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনোয়ারুল হক।
আজাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনোয়ারুল হক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত যদি পাকিস্তানে কোনো আগ্রাসন চালায়, তাহলে পাকিস্তান ‘চূড়ান্ত জবাব’ দেবে। বৃহস্পতিবার আজাদ কাশ্মীরের আইনসভায় দেওয়া এক ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। খবর এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনোয়ারুল হক ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সীমান্ত অতিক্রম করে যদি ভারত কোনো আগ্রাসন চালায়, তাহলে পাকিস্তান ‘চূড়ান্ত জবাব’ দেবে। আনোয়ারুল হক বলেন, ‘ভারতের সাহস নেই পাকিস্তানের সীমান্ত লঙ্ঘনের। কিন্তু যদি করে, তাহলে শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়বে।’ তিনি ভারতের কূটনৈতিক আচরণকে চাণক্য নীতি- অর্থাৎ, ‘কূটনীতির আবরণে ছুরি মারা’- বলেও আখ্যা দেন। তিনি বলেন, কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে ভারত যে গল্প বলছে, তা ভুয়া। ইতোমধ্যে ধরা পড়ে গেছে।
আনোয়ারুল হক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারত কোনো তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহার করে আজাদ কাশ্মীরকে অস্থির করতে চাইতে পারে।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘ভারত যদি এমন কোনো দুঃসাহস দেখায়, তাহলে উপযুক্ত জবাব পাবে।’ আজাদ কাশ্মীরের এই প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ভারত এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ‘পানি আগ্রাসন’ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পূঁছ ও নীলম নদীর প্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো কাজ শুরু করেছে ভারত। এগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। ’মোদি সরকারের সন্ত্রাসের চেহারা বিশ্ব চীনে ফেলেছে বলেও মন্তব্য করেছেন আনোয়ারুল হক। তিনি বলেন, ‘কানাডা থেকে শুরু করে কাশ্মীর পর্যন্ত, মোদির ভারত রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে সন্ত্রাসকে বেছে নিয়েছেন। বিশ্ব আজ তা বুঝে ফেলেছে।’
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে হক বলেন, আজাদ কাশ্মীরের পতাকার পেছনে শক্তি হচ্ছে পাকিস্তান। আমরা যে স্বাধীনতা উপভোগ করি, তা ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে নেই। আমি আমাদের লাইন অব কন্ট্রোলের ওপারের ভাই-বোনদের পাশে আছি। ’তিনি আরও বলেন, ‘যদি ভারত লাইন অব কন্ট্রোল লঙ্ঘন করে, তাহলে জাতিসংঘ সনদের আওতায় পাকিস্তান পালটা জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে।’ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ভারতসহ কোনো দেশই আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘনের সাহস করবে না। আমরা সব সময় প্রস্তুত।’ ভারতের হুমকির প্রতিবাদে আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর (এজেকে)-সহ পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ বিক্ষোভ হয়। স্থানীয় একটি দলের ডাকা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে আজমল বালুচ নামের একজন ব্যবসায়ী সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘ভারত যদি যুদ্ধে জড়াতে চায়, তাহলে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসুক।’ আজমল এবং অন্য বিক্ষোভকারীরা সিন্ধু পানিচুক্তি বাতিলসহ ভারতের ‘অগ্রহণযোগ্য’ নানা হুমকির বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ২৫ বছর বয়সি মুহাম্মদ ওয়াইস বলেন, ‘পানি আমাদের অধিকার এবং আল্লাহর ইচ্ছায়, আমরা এটি পুনরুদ্ধার করব। এমনকি যদি এর জন্য যুদ্ধের মাধ্যমেও কিছু করতে হয়, আমরা পিছু হটব না।’ ভারতবিরোধী স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে মুজাফ্ফরাবাদের মূল শহরেও মিছিল হয়। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সিনিয়র নেতা জাভেদ মীর বলেছেন, ‘ভারত যদি আক্রমণ করার মতো ভুল করে, তাহলে পাকিস্তানি কাশ্মীরিরা সামনের সারিতে লড়াই করবে। আমরা পাকিস্তানের জন্য মরতে প্রস্তুত। ’এছাড়া বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটায়ও বিক্ষোভ হয়েছে। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবারের পেহেলগামে জঙ্গি হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও ডজনের বেশি আহতের ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র করেছে। এই ঘটনায় ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি সংগঠন দায় স্বীকার করেছে। এই সংগঠনটি পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। টিআরএফ এর পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সমর্থন আছে বলে ধারণা করা হয়। লস্কর-ই-তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মুম্বাইয়ে ২৬/১১ সন্ত্রাসী হামলার হোতা হাফিজ মহম্মদ সাঈদ সেই সময় যে সব ‘ছায়া সংগঠন’ গড়ে তুলেছিলেন, সেই সূত্রেই গড়ে উঠেছিল ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)-এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো। এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার ভারতের তরফে সার্ক ভিসা স্কিমের অধীনে পাকিস্তানিদের ভিসা দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এই ভিসার অধীনে ভারতে থাকা পাকিস্তানিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আটারি স্থল সীমান্ত বন্ধের পাশাপাশি ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত। পাশাপাশি দুই দেশের হাইকমিশনে কর্মকর্তা কমানো ও ফিরে যাওয়াসহ একাধিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পাল্টায় ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত এবং ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা বৃহস্পতিবার দিয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতের পাশাপাশি নয়া দিল্লিকে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। তাছাড়া ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধেরও ঘোষণা এসেছে।