ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া দেশের আট মেগা প্রকল্প অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গুরুত্ব হারিয়েছে। প্রকল্পগুলো গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে গতিও হারিয়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অধিক প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। সামনে আরও নতুন মেগা প্রকল্প আসবে। সেগুলো পাইপলাইনে রয়েছে। এসব নতুন প্রকল্প আগামীতে অগ্রধিকার পাবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র।
সূত্র জানায়, আগের সরকারের আমলে নেওয়া ফাস্টট্র্যাকভুক্ত আটটি প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। চলমান সাতটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল মৈত্রী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামুণ্ডমিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। শুরু থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত গড় ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। প্রকল্পগুলোর আওতায় খরচ হয়েছে মোট বরাদ্দের ৭৮ দশমিক ১৬ শতাংশ অর্থ। ফাস্টট্র্যাকভুক্ত ৭ প্রকল্পের মধ্যে কয়েকটির কাজ পুরোপুরি সমাপ্তির পথে। বাকিগুলোও বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তবে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প।
ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পিআরএল ভোগরত সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ফাস্টট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর বিষয়ে আলাদা করে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এগুলোর বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বাস্তবায়ন কাজ চলমান রয়েছে। তবে আগের মতো অগ্রাধিকার পাচ্ছে না, গুরুত্বও কিছুটা কমেছে। কারণ, আগের মতো প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির কোনো বৈঠকও হচ্ছে না।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলে সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বর্তমান সরকার। সে ক্ষেত্রে আগের সরকারের আমলে নেওয়া অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলো গুরুত্ব কম পেতে পারে। তবে প্রত্যাশা থাকবে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকাজ দ্রুত শেষ করা।
জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় একটি রেল প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প থেকে বাদ গেছে রামুণ্ডঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ অংশের নির্মাণকাজ। প্রকল্পটির রামুণ্ডঘুমধুম অংশ বাস্তবায়নে এডিবির অর্থায়নে অপারগতা এবং মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে ট্রান্স এশিয়ান রেল সংযোগ স্থাপন আপাতত সম্ভব নয় বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ত্রুটি এবং দুর্নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে আটটি মেগা প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বা ৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের টাস্কফোর্সের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। এই প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা পরে বেড়ে ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতি চাঙা করতে এবং টেকসই উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ করতে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদকে প্রধান করে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
১২ সদস্যের এই টাস্কফোর্স গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুর্বলতা ও ভুল সিদ্ধান্ত, ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দীর্ঘায়িত ভূমি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, অধিগ্রহণকৃত জমির অপব্যবহার ও অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নকশা।
প্রতিবেদন অনুসারে, বেশিরভাগ প্রকল্প শীর্ষ পর্যায় থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে; যেখানে মন্ত্রী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক দাতাদের ভূমিকা ছিল।
এতে বলা হয়, পরে এটি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এরপর প্রকল্পটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম পরিচালনা ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়, যাতে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়। কারণ, এগুলো ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রকল্প। সবমিলিয়ে প্রকল্পগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন বা অগ্রাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ছিল খুবই সীমিত।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি প্রায় ক্ষেত্রেই ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তথাকথিত পাগলাটে মেগা প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রকল্পের সুবিধা বাড়িয়ে দেখানো এবং ব্যয় অবমূল্যায়নের প্রবণতা দেখা গেছে।
এতে আরও বলা হয়, জমি অধিগ্রহণের কাজটি প্রায়ই শুরু করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে। তাতে এই কাজে অনেক দেরি হওয়ার পাশাপাশি খরচও বাড়ে। এছাড়া জমির মূল্যায়ন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়নের মতো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়াও দুর্নীতির কারণে বিঘ্নিত হয়েছে।
আবার জমিতে মূল পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে বিলাসবহুল বাংলো, সাত তারকা হোটেল, বড় আকারের সেনানিবাস অথবা বন্দর কিংবা শিপইয়ার্ড নির্মাণের মতো প্রকল্পবহির্ভূত কার্যক্রমে সরিয়ে নেওয়ার ?উদাহরণও দেখা গেছে; যা হয়তো প্রকল্পের উদ্দেশ্যর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো উচ্চ নির্মাণব্যয়ের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে প্রাথমিকভাবে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি বা অপ্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের কারণে।
গতি পাবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেগা প্রকল্প : ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মেগা প্রকল্প পেয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। গুরুত্ব বিবেচনায় এ প্রকল্প গতি পাবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় চট্টগ্রামে বে টার্মিনাল নির্মাণে একনেক সভায় ১৩ হাজার ৫২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলার পর অবশেষে বে টার্মিনাল প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হলো এবং শিগগিরই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
তিনি বলেন, আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের বর্ধিত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, পিপিপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পৃথক সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে বে টার্মিনালের টার্মিনাল-১ নির্মাণ করবে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান এবং টার্মিনাল-২ নির্মাণ করবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড।
তিনি বলেন, বে টার্মিনালের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ১৩ হাজার ৫২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা দেবে ৯ হাজার ৩৩৩ কোটি এবং সরকারি তহবিল থেকে খরচ হবে ৪ হাজার ১৯২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পের আওতায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ জলবায়ু সহনশীল ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করা হবে, যা বন্দরের জলোচ্ছ্বাস, স্রোত ও প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে সুরক্ষা দেবে। পাশাপাশি বন্দর অববাহিকা, প্রবেশপথ ও অ্যাক্সেস চ্যানেলের খননকাজও করা হবে।
আধুনিক এই বে টার্মিনাল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অপারেটর দ্বারা পরিচালিত হবে এবং প্যানাম্যাক্স আকারের বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে।
প্রকল্পটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। বিশ্বব্যাংক ও সরকারের অর্থায়নে এই প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের আস্থা যোগাবে এবং ঝুঁকি হ্রাস করবে।