জম্মু কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে উত্তাল পাক-ভারত সীমান্ত। টানা চতুর্থ দিনের মতো কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের গোলাগুলি হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রতিবেশী বৈরী দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উসকানিমূলক মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছেন। এতে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
গতকাল সোমবার ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে, নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ‘বিনা উসকানিতে’ ছোড়া গুলির জবাব দিয়েছে তারা। তারা বলেছে, রোববার দিবাগত রাতেও ভারত ও পাকিস্তানের কাশ্মীর অঞ্চলকে বিভক্ত করা ৭৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নিয়ন্ত্রণরেখায় একাধিক পাকিস্তানি সেনা চৌকি থেকে ‘বিনা উসকানিতে’ ছোড়া গুলির জবাবে ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি করেছে। এ বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিস্তারিত আর কোনো তথ্য দেয়নি। কেউ হতাহত হয়েছে কি না, তাও জানায়নি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি। পেহেলগামে হামলার পর ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশজুড়ে একাধিক সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি নিয়মিত প্রস্তুতিমূলক মহড়া বলে জানিয়েছেন একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।
স্থানীয় একজন পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল সোমবার রয়টার্সকে বলেছেন, জঙ্গিদের খোঁজে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রায় এক হাজার বাড়িতে ও বনে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। এসময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রায় ৫০০ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্তত ৯টি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা ভারত সরকারকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অভিযানে সেখানকার নিরপরাধ ব্যক্তিদের যেন ক্ষতি না হয়। গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘এমন কোনো ভুল পদক্ষেপ, যা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তা এড়িয়ে চলার সময় এসেছে... দোষীদের শাস্তি দিন, তাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাবেন না। কিন্তু গণহারে নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি হতে দেবেন না।’ ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীরা গুলি করে ২৬ পর্যটককে হত্যা করে। ভারত ওই হামলায় জড়িত সন্দেহভাজন অস্ত্রধারীদের তিনজনের মধ্যে দুজনকে পাকিস্তানি বলে শনাক্ত করেছে। তবে ইসলামাবাদ পেহেলগামে হামলায় তাদের কোনো ভূমিকা থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে এ ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এই হামলা ভারতজুড়ে ক্ষোভ ও শোকের জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ডাক উঠেছে। নয়াদিল্লির অভিযোগ, পাকিস্তান কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের মদদ দেয়। উভয় দেশই পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দুইবার যুদ্ধ হয়েছে। পেহেলগামে হামলার পর পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ভারত গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে এবং পাকিস্তান ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারতীয় আগ্রাসনের জবাবে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অটল এবং যে কোনো ধরনের ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানাবে। এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছেন দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। তিনি স্পষ্ট করে জানান, কোনো ধরনের হটকারি পদক্ষেপের জবাব পূর্ণ শক্তি দিয়ে দেয়া হবে। পেহেলগাম হামলার প্রেক্ষাপটে ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে (আইআইওজেকেকে) উত্তেজনার মধ্যে এ মন্তব্য করেন তিনি। পাকিস্তান শুরু থেকে হামলার ঘটনাকে জোরালোভাবে নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু তারপরও নয়াদিল্লি পেহেলগাম হামলার মদতদাতা হিসেবে ইসলামাবাদকে দায়ী করছে।
বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এক ব্রিফিংয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, পাকিস্তান একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হলেও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। পেহেলগাম হামলার ঘটনায় পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি সরাতে এ ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। তারার বলেন, ‘ভারত সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদে জড়িত এবং আমাদের কাছে তাদের কর্মকাণ্ডের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।’ তিনি ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে তহবিল ও অস্ত্র সহায়তার অভিযোগও করেন। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যেই পেহেলগাম হামলার ঘটনা ঘটে, যা অঞ্চলটিতে ভারতের ‘নিরাপত্তা’ দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পাকিস্তান। একইসঙ্গে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে সিন্ধু জলচুক্তি নিয়েও উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে।
সতর্ক করে তারার বলেন, ‘পাকিস্তানের পানির প্রবাহ বন্ধের যে কোনো চেষ্টা বৈরী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হবে।’ তিনি ভারতের এসব কর্মকাণ্ডকে ‘অপরিণত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে এবং এ লড়াইয়ে ৯০ হাজারেরও বেশি প্রাণ হারিয়েছে। আমরা এখনও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সম্মুখভাগে থেকে লড়াই করে যাচ্ছি। তারার বলেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাস দমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন ভারত জাফর এক্সপ্রেস হামলার মতো ঘটনাগুলোর নিন্দা করেনি, যেখানে নিরীহ যাত্রীদের জিম্মি করা হয়েছিল।
পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আব্বাসি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের ১৩০টির বেশি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘এমনি এমনি সাজিয়ে’ রাখা হয়নি, এগুলো ‘শুধুই ভারতের জন্য’ রাখা হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এ খবর দিয়েছে। গত শনিবার হানিফ আব্বাসি আরও বলেন, ‘এসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই তোমাদের (ভারতের) দিকে তাক করা আছে।’ আব্বাসির এমন মন্তব্য দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে দুটি কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে। উভয় দেশই পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। তবে বর্তমানে দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারত ও পাকিস্তান আরও কয়েকবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এজন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন হিমালয় অঞ্চলকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। পাকিস্তানের ‘ফুল স্পেকট্রাম ডিটারেন্স’ নামক সামরিক নীতিমালায় প্রচলিত হুমকিকে প্রতিরোধ করতে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের ‘কোল্ড স্টার্ট ডকট্রিন’-এর নকশা করা হয়েছে দ্রুত হামলা চালানোর কথা মাথায় রেখে। এই বিপরীতমুখী কৌশলগুলোর কারণে যে কোনো সংঘর্ষ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও লেখক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘জনগণের চাপ, গত সপ্তাহের হামলার ভয়াবহতা এবং প্রতিরোধ শক্তি পুনর্গঠনের ইচ্ছাকে বিবেচনায় নিয়ে দিল্লির দিক থেকে কোনো না কোনো ধরনের সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখানো হতে পারে। আর যদি তা ঘটে, তাহলে পাকিস্তান নিজেদের দুর্বল দেখাতে চাইবে না। তারা অবশ্যই পাল্টা জবাব দেবে।’ তবে কুগেলম্যান মনে করেন, সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা নেই। ভারত কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও তারা আসলে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীদের দুর্বল করা এবং প্রতিরোধ শক্তি পুনরুদ্ধার করার মতো সীমিত বিকল্প পথগুলোর কথা ভাবছে।
নয়াদিল্লি অভিযোগ করেছে, পেহেলগামে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনার সঙ্গে ইসলামাবাদের যোগসূত্র রয়েছে। ভারত এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন না করলেও তারা বলছে, অতীতে পাকিস্তান ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীদের সমর্থন দিয়েছিল। হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয়েছে এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে। জবাবে ইসলামাবাদও ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে, ভারতীয়দের ভিসা বাতিল করেছে এবং ভারতীয় বিমান সংস্থার জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করেছে।
এদিকে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে চীন পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছে এবং উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে ফোনালাপে এ সমর্থন জানান। ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের (আইআইওজেকে) পেহেলগাঁও এলাকায় হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে দুই মন্ত্রীর মধ্যে কথা হয়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গভীর-বন্ধুত্বের প্রতীক এবং সর্বক্ষণের কৌশলগত সহযোগী অংশীদার হিসেবে চীন পাকিস্তানের বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগকে সম্পূর্ণভাবে বোঝে এবং এর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। ভারতের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের জন্য চীনের এই সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারত যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে এবং পুরো যুদ্ধ কিংবা সীমিত সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের যে কোনো পরিস্থিতিতে চীনের সমর্থন পাকিস্তানের জন্য ভারতকে প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কূটনৈতিক সূত্র মতে, যুদ্ধের সম্ভাবনা মাথায় রেখে ভারত তার কৌশল নির্ধারণ করলেও ‘চীন ফ্যাক্টর’কে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন কখনওই পাকিস্তানকে ভারতের কাছে দুর্বল হতে দেবে না এবং প্রয়োজনে সামরিক সহায়তাও দিতে পারে। পেহেলগাঁও হামলার পর ভারত যখন পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তখন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে এ আলোচনা হয়। পেহেলগাঁও হামলাটি ২২ এপ্রিল ঘটে, যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘অঞ্চলে স্বাভাবিকতা ফিরেছে’- এই বক্তব্যকে ভেঙে দেয়। পাকিস্তান এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে এবং যে কোনো নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে। ফোনালাপে ওয়াং ই পাকিস্তানের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
ওয়াং ই বলেন, চীন দ্রুত একটি নিরপেক্ষ তদন্ত শুরুর পক্ষে এবং জোর দিয়ে বলছে, সংঘাত কখনও ভারত-পাকিস্তান কিংবা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বয়ে আনবে না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, উভয় দেশ সংযম দেখাবে, একে অপরের দিকে এগিয়ে আসবে এবং উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করবে। ওয়াং ই জানান, চীন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে।
ফোনালাপে ইসহাক দার ওয়াং ই-কে জানান, পাকিস্তান সব সময় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে এবং উত্তেজনা বাড়তে পারে এমন কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। ইসহাক দার আরও বলেন, পাকিস্তান পরিপক্ব মনোভাব নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবে। ওয়াং ই বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সব দেশের যৌথ দায়িত্ব। চীন সবসময় পাকিস্তানের দৃঢ় সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা বিবৃতিতে জানানো হয়, দার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতের একতরফা ও বেআইনি পদক্ষেপ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন প্রচারণার বিষয়ে অবহিত করেন। তিনি পাকিস্তান-চীন বন্ধুত্ব ও সর্বক্ষণের কৌশলগত অংশীদারত্বের প্রতি অটল অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন এবং দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও গভীর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। উভয় পক্ষ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া বাড়াতে এবং একতরফা নীতি ও আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করার প্রত্যয় প্রকাশ করে। তারা সব পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সমন্বয় বজায় রাখার ব্যাপারেও একমত হয়।
এদিকে, ইসহাক দার যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গেও কথা বলেন। সেখানে তিনি ভারতের মিথ্যা অভিযোগ, ভিত্তিহীন প্রচারণা এবং একতরফাভাবে সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিত করার বেআইনি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেন, যা ভারতের আন্তর্জাতিক দায়িত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন। দার জানান, পাকিস্তান জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তবে একইসঙ্গে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ডেভিড ল্যামি উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উত্তেজনা কমাতে পাকিস্তানের ইতিবাচক মনোভাবের প্রশংসা করে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখবে এবং দুই দেশের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ বজায় রাখবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) পেহেলগাঁও হামলা নিয়ে প্রকাশিত বিবৃতিতে শক্ত ভাষা ব্যবহৃত না হওয়ায় ভারতের পরিকল্পনায় বড় ধাক্কা লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানের সক্রিয় কূটনীতি এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোমবার এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে দ্য নিউজ ডট কম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার সময় ভারত যে ধরনের কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল, এবার তা ব্যবহার করা হয়নি।
ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে (আইআইওজেকেকে) পর্যটকদের ওপর হামলার পর নিহতের সংখ্যা ২৬-এ দাঁড়ালেও, জাতিসংঘের বিবৃতিতে শুধুমাত্র ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে; সরাসরি ভারতের নাম উল্লেখ করা হয়নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতির খসড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব করেছিল, তবে তা অনুমোদিত হয়নি। ২২ এপ্রিলের হামলার পর থেকে দুই প্রতিবেশী পরমাণু শক্তিধর দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটেছে। নয়াদিল্লি সিন্ধু জলচুক্তি (ইন্দাস ওয়াটার্স ট্রিটি) সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করলে, এর জবাবে পাকিস্তান তার আকাশসীমা ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য বন্ধ করে দেয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ হামলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করে একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের জন্য অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পাকিস্তান কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু বিতর্কিত কিছু শব্দ জাতিসংঘের বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া রোধ করতেই নয়, বরং ভারতের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কেবল ‘পেহেলগাঁও’ শব্দ ব্যবহার ঠেকিয়ে ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ শব্দ যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে- যার মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের বিতর্কিত মর্যাদার বিষয়টি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া, ভারত হামলার বিষয়ে দ্রুত কোনো প্রকাশ্য নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সংস্থাটি অঞ্চলটির পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। পাশাপাশি, জাতিসংঘ পাকিস্তান ও ভারতকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানান, যেন ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে পরিস্থিতির আরও অবনতি না ঘটে।
এদিকে একের পর এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর বাড়ি ধ্বংস করা নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনকে সতর্ক করল সব রাজনৈতিক দল। প্রায় সবাই বলেছেন, এমন কিছু করা ঠিক নয়, যা মানুষকে নতুনভাবে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। উপত্যকার রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্যই জারি রাখতে হবে, কিন্তু ভুল পদক্ষেপ ঠিক নয়। তাতে হিতে বিপরীত হবে। পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর নৃশংস আক্রমণে ২৬ জনের মৃত্যুর পর জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন উপত্যকাজুড়ে জঙ্গি সন্ধান শুরু করেছে। এই অভিযানে এরইমধ্যে বিভিন্ন স্থানে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের ডজনখানেক ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাঙার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বুলডোজার। কোথাও নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণও ঘটানো হয়েছে। ভেঙে দেওয়া বাড়ির ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
২২ এপ্রিল পেহেলগামকাণ্ডে জড়িত বলে যাদের স্কেচ প্রকাশ করা হয়েছিল, তাদের পরিবারের ঘরবাড়িও রয়েছে। আর আছে সন্দেহভাজন উগ্রপন্থিদের বাড়ি। এমনই একজন কুপওয়ারা জেলার কালারুস এলাকার ফারুক আহমেদ টেডওয়া। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ফারুক আহমেদ ১৯৯০ সাল থেকেই নিখোঁজ। অভিযোগ, পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর তার আর খোঁজ নেই। গত শনিবার ফারুকের বাড়ি ধূলিসাৎ করার পর সেই পরিবারের একজন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘পরিবার ছেড়ে ফারুক সেই কবে থেকে নিরুদ্দেশ। কোথায় গেছে, কেমন আছে কিছুই জানা নেই। আমাদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হলো। আমাদের অপরাধ কী? কোথায় যাব আমরা?’
এই প্রশ্নেই তোলপাড় হচ্ছে উপত্যকা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা এই বিচারের উত্তর খুঁজছেন। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ গণমাধ্যমে এই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘পেহেলগামের ঘটনার পর অবশ্যই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নির্ণায়ক লড়াই চালাতে হবে। মূলে আঘাত করতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে যেন ভুল পদক্ষেপ না হয়।’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের হত্যার প্রতিবাদে উপত্যকার সব মানুষ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রাস্তায় নেমেছে। প্রতিবাদী হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। সেই আচরণ স্বতঃস্ফূর্ত। এই সমর্থনকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। দেখতে হবে কোনো ভুল পদক্ষেপ যেন না করা হয়। নিরপরাধ কাশ্মীরিদের যেন ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয়।’
জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচিত সরকার থাকলেও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার সুবাদে আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে নির্বাচিত সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই। নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রস্তুতি ও বৈঠকও করা হয় মুখ্যমন্ত্রীকে বাইরে রেখে। পেহেলগামের ঘটনার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে ও জঙ্গি ধরতে এরইমধ্যে পাঁচশ’ এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে। সহস্রাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। পাশাপাশি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সন্দেহভাজন পলাতক সন্ত্রাসীদের পারিবারিক আস্তানা। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি ও পিপলস কনফারেন্স নেতা সাজ্জাদ লোনের পাশাপাশি হুরিয়ৎ কনফারেন্সের চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ উমর ফারুকও প্রশাসনের বুলডোজার নীতির সমালোচনা করেছেন। মেহবুবা ‘এক্স’ মারফত জানিয়েছেন, ‘সরকারের উচিত সাবধানী পদক্ষেপ নেওয়া। সন্ত্রাসবাদী ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের মধ্যে ফারাকটা বুঝতে হবে। এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা নিরপরাধ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তারা যেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ মেহবুবা আরও বলেছেন, ‘সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ, প্রশাসনকে যেন সতর্ক করে দেওয়া হয়। সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হলে জঙ্গিদেরই লাভ।’ একই কথা বলেছেন সাবেক মন্ত্রী সাজ্জাদ লোন। তিনিও এক্সে লিখেছেন, ‘পেহেলগামকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও গণপ্রতিবাদ গত ৭৮ বছরে কাশ্মীরে দেখা যায়নি।
মানসিকতার এ এক বিশাল পরিবর্তন। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, আশা করি তারা এই পরিবর্তনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। এমন কিছু করা ঠিক নয়, যা মানুষকে পুরোনো মানসিকতায় ফিরিয়ে নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ এমন ভাবতে শুরু করেছে যে একজনের অপরাধের ফল পরিবারের সবাইকে ভুগতে হচ্ছে। একজনের শাস্তি পুরো পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে।’ হুরিয়ৎ কনফারেন্স নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুকও সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘গোটা কাশ্মীর সমষ্টিগতভাবে পেহেলগামের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে। অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু নিরীহ মানুষেরা যেন শাস্তি না পান। লাগামছাড়া ধরপাকড় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার ছবি মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।’ প্রশাসনের প্রতি তার আবেদন, ‘অনুগ্রহ করে নিরীহ মানুষদের শাস্তি দেবেন না।’