আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গতকাল শনিবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে। সমাবেশে ১২ দফা দাবিসহ হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বর ও জুলাই গণহত্যার বিচারের গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়। মহাসমাবেশে অংশ নিতে গতকাল ভোর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হন। সকাল ৯টায় মহাসমাবেশ শুরু হয়ে বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত চলে। মহাসমাবেশের শেষ পর্যায়ে চার দফা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান। প্রথমত- আগামী ২৩ মে ৪ দফা দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ, দ্বিতীয়ত- নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ, তৃতীয়ত- দেশের যৌতুকপ্রথা বন্ধে কঠোর আইন করা এবং চতুর্থ- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে গত শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিক্ষোভ করে। এনসিপির সমাবেশের একদিন পর একই দাবিতে হেফাজতে ইসলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করল। মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক ১২ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলোর মধ্যে- জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা ও তার চিহ্নিত দোসরদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তাদের কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিলপূর্বক আলেমণ্ডওলামাদের পরামর্শক্রমে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারী সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। নারীর সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা মূল্যবোধ নয় বরং আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকেই বাস্তবমুখী সংস্কারের দিকে যেতে হবে। সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে হবে। ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ঈমান ও আমল রক্ষার্থে বহুত্ববাদ নামক আত্মঘাতী ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। এছাড়া লিঙ্গ পরিচয়, লিঙ্গ বৈচিত্র্য, লিঙ্গ সমতা, তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে কাউকে বাদ দিয়ে নয় এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগানের অন্তরালে এবং অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শব্দের আড়ালে এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজবিধ্বংসী ধর্মবিরুদ্ধ সমকামীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে। আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর নামে কটূক্তিকারী ও বিষোদ্গার বন্ধে কঠোর আইন করতে হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ধর্মীয় অবমাননা সংক্রান্ত শাস্তির আইনি ধারাগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ বাতিল করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শহীদ সাইফুল ইসলাম হত্যার উসকানিদাতা চিন্ময় দাসের জামিন প্রত্যাহারপূর্বক তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে প্রতিবাদী আলেমণ্ডওলামা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ইসলামমনা তরুণদের বিরুদ্ধে হওয়া মিথ্যা ও বানোয়াট সব মামলা অতিসত্বর প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তি করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। সেইসঙ্গে জঙ্গি নাটক বা জঙ্গি কার্ড খেলে বাংলাদেশকে ইসলামপন্থি ও আলেমণ্ডওলামাদের গত ১৫ বছর যারা নির্যাতন চালিয়েছিল তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গাজার মুসলমানদের ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা ও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদে আমাদের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এই সরকারকে কূটনৈতিকভাবে আরও উচ্চকণ্ঠ হতে হবে এবং দেশের সর্বস্তরের জনতাকে ইসরায়েলি ভারতীয় পণ্য বয়কট করতে হবে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সব পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। রাখাইনকে মানবিক করিডোর প্রদানে সরকারের সম্মত হওয়া সম্পূর্ণরূপে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তার স্বার্থে এ অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে অবশ্যই অনতিবিলম্বে ফিরে আসতে হবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশি মিশনারি অপতৎপরতা ও দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভৌগোলিক ও খণ্ডতায় নিরাপত্তা সংকট কমাতে আলেম সমাজের দাওয়াতি কার্যক্রমকে আরও নিরাপদ ও সুযোগ করে দিতে হবে। সেখানে সামরিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও বৃদ্ধি করা ছাড়াও পাহাড়ি ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্থিতিশীলতা বিনির্মাণে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। এসময় মাহফুজুল হক ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের গণহত্যাসহ জুলাই আন্দোলনের ৮৪ জন মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষকসহ সব শহিদকে স্মরণ করে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। একই সঙ্গে আহতদের দ্রুত সুস্থতা ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
নারী সংস্কার কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরী বলেন, কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন মেনে নেওয়া হবে না। নারী সংস্কার কমিশন ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম নারীদের অধিকার ও মূল্যবোধের পক্ষে। মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
হেফাজতের নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার : হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলছি, আগামী দুই মাসের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সব নেতাকর্মীকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।’
শাপলা চত্বরে ‘গণহত্যা’ : পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের আমলে শাপলা চত্বরে সংঘটিত ঘটনার জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করার আহ্বান জানিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। হেফাজতের মহাসমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। এসময় মাহমুদুর রহমান বলেন, আজকে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি শাপলা চত্বরে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। একই সঙ্গে আমি জুলাই বিপ্লবের শহিদদেরও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে গণহত্যার পর এই প্রথম স্বাধীনভাবে কোনো প্রোগ্রাম করতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমি একটা বিষয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি হেফাজতের পক্ষ থেকে কেন এতদিনেও সেই দানব ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। আপনারা কেন এখনও মামলা দায়ের করেননি, আমি জানি না। আমি মনে করি, শাপলা চত্বরে যতজন নিহত হয়েছেন তাদের সবার হয়ে গণহত্যার দায়ে হাসিনার নামে মামলা করতে হবে। এটাই আমার প্রথম দাবি। দ্বিতীয় দাবি, বিশ্বের মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা।
হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘আমার ভাই আবরার, আবু সাঈদের রক্তের ওপর পারা দিয়ে এই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আসবে না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার। এখানে যদি, কিন্তু, আচ্ছা, দেখি নেই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে।’
মহাসমাবেশে হেফাজতের আমির মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন আলোচিত ইসলামি বক্তা ও জৈনপুরের পীর মুফতি ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী। হেফাজত নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নায়েবে আমির মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, ড. আহমদ আবদুল কাদের, মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী, মুফতি জসীম উদ্দিন, মাওলানা আব্দুল আউয়াল, সরোয়ার কামাল আজিজি, মহিউদ্দিন রাব্বানী, আহমেদ আলী কাসেমী, মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমী, মাহবুব জাকারিয়া, মাওলানা আব্দুল কাদের, মাওলানা আইউব বাবুনগরী, মাওলানা আফজালুর রহমান। যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, জুনায়েদ আল হাবিব, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবী, হাসান জামিল, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, ইসলামী বক্তা মুফতি রেজাউল করিম আবরার, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মুফতি মনির হোসেন কাসেমী, চরমোনাই পীরের সাহেবজাদা, সৈয়দ ইসহাক মোহাম্মদ আবুল খায়ের, মুফতি খলিলুর রহমান নেছারাবাদী ও মধুপুরের পীর মাওলানা আব্দুল হামিদ প্রমুখ।