যুদ্ধের মাত্র চার দিনের মাথায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করেছে ভারত ও পাকিস্তান। এই যুদ্ধবিরতির নেপথ্যের ঘটনা উঠে এসেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সিনিয়র সাংবাদিক নিক রবার্টসনের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ভারতীয় হামলার পর পাকিস্তানের জোরালো প্রতিশোধমূলক হামলা নয়াদিল্লিকে বিচলিত করে তোলে। অবশেষে, উত্তেজনা থামাতে জরুরি মার্কিন মধ্যস্থতা চাইতে বাধ্য হন নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা। গত শনিবার সিএনএনের সঙ্গে কথা বলার সময় রবার্টসন বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানের তিনটি বিমানঘাঁটিতে হামলার পর পাকিস্তান ভারতীয় সামরিক স্থাপনা, বিমানঘাঁটি ও অস্ত্র সংরক্ষণাগারে বিপুল সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট দিয়ে হামলা করে।’ তিনি বলেন, ‘এটি সত্যি যে, লড়াইয়ে ভারত বেশ পিছিয়ে পড়েছিল; কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকরা। এমনটা হবে তারা ধারণা করতে পারেননি।’
ধারণার বাইরে ক্ষয়ক্ষতি হয় ভারতের: দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয় ৭ মে, যখন ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে হামলা চালায় এবং এতে অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, যাদের মধ্যে শিশুও ছিল। এর জবাবে পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে, যার মধ্যে তিনটি ছিল রাফাল, পাশাপাশি ডজনখানেক ড্রোন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এসময় ভারত বেশ কিছু ড্রোন পাকিস্তানের আকাশসীমায় পাঠায়, যেগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০টি গুলি করে ভূপাতিত করে পাকিস্তান। এসব ড্রোনের মধ্যে ইসরায়েলের তৈরি আইএই হেরন ইউএভিও ছিল। গত শুক্রবার রাতে ভারত পাকিস্তানের তিনটি বিমানঘাঁটি- নূর খান, মুরিদ ও শরকোটে একযোগে মিসাইল হামলা চালায়। এসব মিসাইল বিমান থেকেই ছোড়া হয় বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী। এর জবাবে শনিবার সকালেই পাকিস্তান শুরু করে ‘অপারেশন বুনিয়ানুম মারসুস’, যার লক্ষ্য ছিল ভারতের একাধিক সামরিক ঘাঁটি এবং উত্তর ভারতের একটি মিসাইল সংরক্ষণ কেন্দ্র। এই অভিযানে দুটি বিমানঘাঁটি, একটি মিসাইল ডিপো ও একটি এস-ফোর হানড্রেড আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয় বলে জানায় পাকিস্তান। এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ভারত ও পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। শনিবার বিকাল ৫টা থেকে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রশংসায় শেহবাজ: যুদ্ধবিরতি কার্যকরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিকে পাকিস্তানের ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। শনিবার মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শেহবাজ শরিফ ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা করেন এবং সৌদি আরব, চীন, তুরস্ক, কাতার ও যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশকে ধন্যবাদ জানান। শেহবাজ চীনকে ‘অত্যন্ত কাছের, খুব বিশ্বাসযোগ্য’ এক বন্ধু দেশ বলে আখ্যায়িত করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতিতে ‘সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে’ বলে উল্লেখ করেন। পাক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শান্তিকামী রাষ্ট্র। কোটি কোটি মানুষের বাস পাকিস্তানে। প্রত্যেকের জন্যই লাভজনক হবে ভেবেই আমরা যুদ্ধবিরতির এই পদক্ষেপ নিয়েছি।’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দেশ একটা ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ পেয়েছে। এজন্য তিনি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীকে এক এক করে নাম উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানান। তার কথায়, দেশের মূলনীতিগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তারা। ভাষণের শুরুতেই শেহবাজ শরিফ বলেন, ‘কেউ যদি আমাদের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে প্রতিরোধের জন্য যা করতে হয়, করব।’ তার দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভিত্তিহীন ‘অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত’ দাবি করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ভাষণ শুরুর আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘বার বার যুদ্ধবিরতির সমঝোতা লঙ্ঘনের’ যে অভিযাগ তুলেছেন, এ ব্যাপারে শেহবাজ শরিফ কোনো মন্তব্য করেননি। বরং, যুদ্ধবিরতির চুক্তি ‘সবার কল্যাণের জন্য’ করা হয়েছে বলে তিনি ভাষণে উল্লেখ করেন। এছাড়া পানিবণ্টন ও কাশ্মীরসহ বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব বলেও আশা প্রকাশ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
আগে নাকচ করলেও এখন আলোচনায় রাজি ভারত: যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও নিশ্চিত করেছেন, দুই দেশ একটি নিরপেক্ষ স্থানে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হওয়াটা ভারতের জন্য স্পষ্টত পিছু হটার ঘটনা, যা দেশটির জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুবীর সিনহা বলেছেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা অবশ্যই স্বাগতযোগ্য। বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য, যারা কিছুদিন ধরে অবিরাম গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে সামনে যে বৃহত্তর দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আসতে চলেছে, যে আলোচনার কথা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তা ভারতের জন্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে খুবই কঠিন একটি পথ হতে পারে। কারণ, ভারত এতদিন ধরে এ ধরনের প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। সিনহার ভাষায়, ‘মোদি সরকারের কথিত ‘শক্ত অবস্থান’ নীতির একটি বড় অংশ ছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনো বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই নীতি কূটনীতি নয়, বরং সামরিক প্রস্তুতি এবং নতুন অস্ত্র কেনা ও তা প্রদর্শনের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।’ এই বিশ্লেষকের মতে, এমন প্রেক্ষাপটে সেই আলোচনায় ফিরে যাওয়াটা ভারতের পূর্বেকার অবস্থান থেকে স্পষ্টভাবে পিছু হটার ইঙ্গিত দেয়। একইসঙ্গে ভারতের উগ্রপন্থি রাজনৈতিক মহলে, যারা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে হামলা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তাদের মধ্যে এটা অসন্তোষ ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। সিনহা আরও বলেন, ভবিষ্যৎ আলোচনার ভিত্তি হিসেবে সিন্ধু পানি চুক্তি এবং সিমলা চুক্তি, যেগুলো ভারত সম্প্রতি বাতিল করার হুমকি দিয়েছিল, এগুলো ভারতকে আবার পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কি শেষমেশ নিজের পায়েই কুড়াল মারল?
‘ভীতিকর গোয়েন্দা তথ্য’ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে: অন্য এক খবরে সিএনএন জানিয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দল পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। তবে গত শুক্রবার সকালে তাদের কাছে এক ‘ভীতিকর গোয়েন্দা তথ্য’ পৌঁছায়। এর পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাতে সিএনএন জানায়, শুক্রবার সকালে মার্কিন প্রশাসনের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল গোয়েন্দা তথ্য আসে, যার ভিত্তিতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অফ স্টাফ স্যুজি ওয়াইলস পরস্পরের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। এরপরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সংক্ষিপ্তভাবে অবহিত করে ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। শুক্রবার দুপুরে (ইস্টার্ন টাইম) মোদির সঙ্গে ওই আলোচনায় ভ্যান্স জানান, পরিস্থিতি দ্রুতই ‘নাটকীয় মাত্রায়’ পৌঁছাতে পারে এবং উত্তেজনা নিরসনে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ জরুরি। সূত্র অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস ছিল, ওই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো কার্যকর যোগাযোগ হচ্ছিল না। তাই দুই দেশের মধ্যে ‘ডায়ালগ চ্যানেল’ চালু করাই ছিল মার্কিনিদের মূল লক্ষ্য। ভ্যান্স মোদিকে এমন কিছু বিকল্প প্রস্তাবও দেন, যেগুলো পাকিস্তান গ্রহণ করতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা। সেই রাতেই মার্কো রুবিওর নেতৃত্বে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা ভারত ও পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন।