দেশজুড়ে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এতে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং এসব অভিযোগ দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেহেতু উল্লিখিত অপরাধগুলোর অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং দেশের ফৌজদারি আদালতে বহুসংখ্যক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, যেহেতু এসব মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন কর্তৃক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্য নেতাকর্মী কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অপরাধমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, দলটি এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলার বাদী ও সাক্ষীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে ও এভাবে বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশে সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সেহেতু সরকার যুক্তিসংগতভাবে মনে করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা-১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটি এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সমীচীন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা সংশোধন: ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুযোগ থাকলেও দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিধান ছিল না। গত শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা সংশোধন করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০২৫’-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এরপর গত রোববার দল বা সংগঠনের (সত্তার) কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধ্যাদেশ সংশোধন করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০২৫’-এর গেজেট প্রকাশ করে আইন মন্ত্রণালয়। এখন থেকে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে আর কোনো বাধা থাকল না। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচারণার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে এই আইনের সংশোধনিতে।
গত শনিবার রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে ১৯৯৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ২০০৯ সালের ১৬নং আইনের ধারা ১৮ সংশোধন করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ (২০০৯ সালের ১৬নং আইন), অতঃপর উক্ত আইন বলিয়া উল্লিখিত, এর ধারা ১৮-এর উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত ‘সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তপশিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে’ শব্দগুলোর পর ‘বা সত্তার যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করিতে পারিবে’ শব্দগুলো সংযোজিত হইবে।
আইনের ধারা ২০-এর সংশোধন: উক্ত আইনের ধারা ২০-এর (ক) উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত ‘যদি কোনো ব্যক্তিকে ধারা ১৮-এর বিধান অনুসারে তালিকাভুক্ত করা হয় বা কোনো সত্তাকে নিষিদ্ধ করা হয়’ শব্দগুলো ও সংখ্যার পরিবর্তে ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তার বিরুদ্ধে ধারা ১৮-এর উপ-ধারা (১)-এ বর্ণিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়’ শব্দগুলো, সংখ্যাগুলো ও বন্ধনী প্রতিস্থাপিত হইবে; (খ) উপ-ধারা (১)-এর (অ) দফা (গ)-তে উল্লিখিত ‘নিষিদ্ধ’ শব্দের পরিবর্তে ‘উক্ত’ শব্দ প্রতিস্থাপিত হইবে; এবং (আ) দফা (ঙ)-এর পরিবর্তে নিম্নরূপ দফা (ঙ) প্রতিস্থাপিত হইবে, যথা:- (ঙ) উক্ত সত্তা বা উহার পক্ষে বা সমর্থনে যে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা বা মুদ্রণ কিংবা গণমাধ্যম, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য যে কোনো মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, অথবা মিছিল, সভা-সমাবেশ বা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ করিবে। (গ) উপ-ধারা (২)-এ উল্লিখিত ‘নিষিদ্ধ’ শব্দের পরিবর্তে ‘উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত’ শব্দগুলো, সংখ্যা ও বন্ধনী প্রতিস্থাপিত হইবে; এবং (ঘ) উপ-ধারা (৩)-এ উল্লিখিত ‘তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা নিষিদ্ধ সংগঠনের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘ধারা ১৮-এর উপ-ধারা (১)-এর অধীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছে এরূপ কোনো ব্যক্তি বা সত্তার’ শব্দগুলো, সংখ্যাগুলো ও বন্ধনী প্রতিস্থাপিত হইবে।