দেশের রাজস্ব খাত, প্রশাসনের গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজস্ব নীতি বিভাগের কাজ হবে আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, আর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মূল কাজ হবে জাতীয় রাজস্ব সংগ্রহ। গত সোমবার রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অনুমোদনের পর ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়।
নতুন এই অধ্যাদেশ জারির ফলে দীর্ঘদিনের রাজস্ব সংস্থা এনবিআরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের মুদ্রণ ও প্রকাশনা শাখা থেকে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেছেন, কারণ সংসদ বর্তমানে ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য : কর আদায় বাড়াতে কর কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে দুই স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। এমন বড় ধরনের একটি কাঠামোগত সংস্কারের উদ্দেশ্য ও কারণ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে সরকার।
রাজস্ব নীতি বিভাগ : অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ নামে নতুন যে বিভাগ গঠিত হবে, সেটির কাজ হবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব জোগানে সম্প্রসারণমূলক কর ভিত্তি, যৌক্তিক করহার, সীমিত কর অব্যাহতি নীতি অনুসরণ করে উত্তম কর ব্যবস্থা তৈরি করা। এছাড়া স্ট্যাম্প আইনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন নতুনভাবে প্রণয়ন বা সংশোধন করা, স্ট্যাম্প ডিউটি, আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ ও অন্যান্য শুল্ক-কর, ফি আরোপ, হ্রাস-বৃদ্ধি ও অব্যাহতি প্রদানসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই বিভাগ। পাশাপাশি কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন; কাস্টমসসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন ও মতামত প্রদান; আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিসংক্রান্ত কার্যক্রম; রাজস্বসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যথাযথ প্রক্ষেপণ ও প্রাক্কলন করা; রাজস্ব নীতি-সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান, প্রজ্ঞাপন, এসআরও প্রণয়ন, সংশোধন ও ব্যাখ্যা প্রদান করবে এই বিভাগ। এই বিভাগের জনবল সম্পর্কে বলা হয়েছে, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞদের দিয়ে বিভাগটির বিভিন্ন পদ পূরণ করা হবে। আর সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে বলে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে। এ বিভাগকে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞ, হিসাব ও নিরীক্ষা বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী প্রতিনিধি, ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ: অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠিত হবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এ বিভাগের কাজের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ; কাস্টমসসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন; আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহারসংক্রান্ত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন; কর ভিত্তি সম্প্রসারণে করসেবা, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি জোরদার করা এবং সবাইকে করজালের মধ্যে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ; রাজস্ব ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন; রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রাজস্ব নীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা এবং নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। তবে এসব জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিআর বিলুপ্তি করে দুটি বিভাগ করায় রাজস্ব খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। নীতি ও বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ আলাদা হওয়ায় নীতিগত উন্নয়ন ও কার্যকারিতা বাড়ানো সহজ হবে। ভবিষ্যতে বাজেট পরিকল্পনা ও রাজস্ব সংগ্রহে দক্ষতা ও গতি আসবে।
রাজস্ব বাড়ানোর সংশয় দূরীকরণ: বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই এনবিআর সংস্কারের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। তাদের মতে, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সংঘর্ষ থাকলে কর প্রশাসনের দক্ষতা কমে যায়। এ সংস্কার সেই আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতারই ফল। টিআইবি, সিপিডি ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরই) মতো সংস্থাগুলোর মতে, যদি নীতি বিভাগ যথাযথভাবে গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা করতে পারে এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগ তা দক্ষতার সঙ্গে কার্যকর করে, তবে রাজস্ব জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
এনবিআর বিলুপ্তি করে দুটি বিভাগ করায় কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডাররা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সেই অসন্তোষের বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে দুটি বিভাগ গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সব দেশেই এমন আলাদা বিভাগ থাকে। এনবিআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেই করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের প্রভাব পড়বে না। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়বে না। এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় গতবারের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি হয়েছে। খুব হতাশাব্যাঞ্জক নয়, আমরা আরও প্রত্যাশা করছি। অন্তত গতবারের তুলনায় কম হবে না।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাদের পেশাদার হতে হবে; অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান- এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তারা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না।
আগামী বাজেট সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বাজেটে বড় ঘাটতি থাকবে না। প্রকল্প, এডিপি বাস্তবায়ন- এসব করা হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। ব্যাংক থেকে ধার করে, টাকা ছাপিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করা হবে না। কিছুটা তো ঘাটতি থাকবে। সেটা পূরণ করতে আমরা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি, সে ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি সফল’।
৫০ বছর ধরে রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ এনবিআর : এনবিআর বিলুপ্ত করার মূল লক্ষ্য- করনীতি প্রণয়ন ও কর ব্যবস্থাপনার কাজ আলাদা করা। দক্ষতা বাড়ানো, স্বার্থের সংঘাত হ্রাস ও দেশের কর ভিত্তি প্রসারিত করা। এনবিআর বিলুপ্তর পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। বিশ্বে কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়ায় এই অনুপাত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত অর্জন করতেই হবে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, নীতি প্রণয়নে রাজস্ব আহরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; ন্যায়বিচার, প্রবৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা উপেক্ষা করা হয়েছে। এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ গঠন করা হলে দীর্ঘদিনের এসব জটিল সমস্যা সমাধানে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রণয়ন করা যাবে।
সরকারকে অভিনন্দন: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে বিসিএস আয়কর অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল বিসিএস আয়কর অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক পেইজে এ অভিনন্দন বার্তা জানানো হয়। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতাসিম বিল্লাহ ফারুকী অভিনন্দন বার্তায় বলেন, ‘সবাইকে ধন্যবাদ, আমাদের দাবি মেনে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। আমরা আনন্দিত। ধন্যবাদ অর্থ উপদেষ্টা ও চেয়ারম্যানকে। আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাকি বিষয়গুলো উপদেষ্টা মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করে, চেয়ারম্যান মহোদয়ের নেতৃত্বে পরবর্তী পদক্ষেপ জরুরি। সবাই মিলেমিশে কাজ করতে হবে।’