চট্টগ্রাম বন্দরকে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড আখ্যায়িত করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরই একমাত্র ভরসা। চট্টগ্রাম বন্দরকে সত্যিকার বন্দরে পরিণত করার কাজ চলছে। গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ইয়ার্ড-৫ পরিদর্শনে গিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবার চট্টগ্রামে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার চিন্তার কারণ একটাই, বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি পাল্টাতে হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরই হলো ভরসা। এটাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি, নতুন কোনো পাতা, নতুন কোনো অধ্যায়ে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই। এই পথ খুলে দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পথ খোলে। এই পথ না খুললে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যতই লাফালাফি করো, ঝাঁপাঝাঁপি করো, কিছুই হবে না।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘কেন আমি এটি নিয়ে ভাবি। একজনকে বলছিলাম, চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড দুর্বল হলে ডাক্তার, বৈদ্য, সবকিছু আনো; মেরামত হবে, কিন্তু চলবে না। ছোট্ট একটি হৃৎপিণ্ড, তার মধ্যে হলো রোগাক্রান্ত, এই হৃৎপিণ্ডে যতই ঠেলাঠেলি করো, রক্ত সঞ্চালন হবে না। এটিই যদি একমত হই- বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর, তাহলে যে সাইজের হৃৎপিণ্ড আছে, ওই সাইজে চলে না। এই হৃৎপিণ্ড বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড হতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কাজেই আমরা বললাম যে পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাকো। দেখলাম যে আগেই ডাকা হয়েছে, কিন্তু কাজটা হচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি, এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশে অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের দিয়ে পরিচালনার প্রক্রিয়া চলছে। আওয়ামী লীগ আমলে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর মধ্যে লালদিয়ার চর ও বে-টার্মিনালে অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি খাতে পুরো বিনিয়োগ করতে হবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তবে নিউমুরিং টার্মিনালে পুরোদমে চালু থাকায় এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে স্থানীয় শ্রমিক ও অপারেটররা আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শুরুতে বিদেশি অপারেটরদের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গটি টেনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি সাখাওয়াতকে (নৌপরিবহন উপদেষ্টা) বলেছি, আমি আর শুনতে চাই না, অমুক তারিখের মধ্যে সব দিয়ে দিতে হবে। যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ যদি রাজি না হয়, জোরাজুরি নয়, রাজি করিয়েই করতে হবে। কারণ, এটা এমন এক বিষয়, পুরো জিনিস শুনলে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ: চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে আগের তুলনায় অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নানা উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতার কথা শোনেন ড. ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা অনেক রকম থিওরিটিক্যাল আলোচনা করেছি, সেসব আর করতে চাই না, আমরা চাই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে। কিন্তু সেটা একবারেই হবে না, তাই আমাদের ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এবছর যেহেতু বর্ষা মৌসুম এরইমধ্যে এসে গেছে তাই এবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না। কিন্তু গত কয়েক মাসে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে যদি এবছর আশানুরূপ ফল না আসে তাহলে তো সব কিছু মনে হবে জলে গেল।’ চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক অর্জনের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে একটি প্রতীকী ও খুবই জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নিরসন করা গেলে অন্যান্য শহর ও জেলা উৎসাহিত হবে। তাই চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এই সমস্যা নিরসনে নিয়মিত তাগিদ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের যে সক্ষমতা রয়েছে অন্য অনেক অনেক শহরের তা নেই। তাই চট্টগ্রামের সব প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে হবে। নাগরিক সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে।’
কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন: চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ইয়ার্ড-৫ পরিদর্শনের আগে বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বহুল প্রত্যাশিত কর্ণফুলী নদীর ওপর রেলসহ সড়কসেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। কর্ণফুলী নদীর ওপর দিয়ে বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলাসহ দক্ষিণ জেলার মানুষের প্রাণের দাবি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। সেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্যদিয়ে বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী উৎফুল্ল। সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্বোধনের পর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কালুরঘাট ব্রিজে আমার অনেক স্মৃতি। এই সেতুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। এখানে বোয়ালখালীর বাসিন্দাও উপস্থিত আছেন। কালুরঘাট সেতু তাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত। এটি তৈরি হয়ে গেলে চট্টগ্রামবাসীর বহু কষ্টের অবসান হবে।’ ওই দিন বিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পঞ্চম সমাবর্তনে যোগদান করেন তিনি। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডি-লিট (ডক্টর অব লিটারেচার) ডিগ্রি দেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার প্রধান উপদেষ্টার হাতে এই ডিগ্রি তুলে দেন।
চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের জমির দলিল হস্তান্তর: চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের জন্য ২৩ একর জমির দলিল হার্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুস সালামের কাছে হস্তান্তর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালটি পাহাড়তলী থানাধীন দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় নির্মিত হবে। এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসীর আন্তর্জাতিক মানের বিশেষায়িত হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি পূরণ হতে চলেছে। চট্টগ্রাম সফরে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পর তার পৈতৃক বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রাম পরিদর্শন করেন।