রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য নিহতের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ। ঘটনাটি কেন্দ্র করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। এছাড়াও গতকাল বুধবার জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বন্ধু, সহপাঠী ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন ক্যাম্পাসে। বিক্ষোভে মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন নেতারা।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘সে (শাহরিয়ার আলম সাম্য) আর সোজা হয়ে দাঁড়াবে না, আর কোনো কনসার্টে যাবে না, গানের তালে নাচবে না, স্বপ্ন দেখবে না আর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এটা শুধু একজন মানুষের হত্যা ছিল না, এটা ছিল হাজারো স্বপ্নের মৃত্যু। আমরা আমাদের ছেলে সাম্যর জন্য বিচার চাই। আমাদের সন্তানের হত্যার বিচার চাই। জবাব দিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।’
গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে নেতাকর্মীরা স্লোগান দেন- ‘দফা এক দাবি এক, ভিসির পদত্যাগ’, ‘আমার ভাইয়ের লাশ পড়ে, প্রশাসন কী করে’, ‘নয় মাসে দুই খুন, ভিসি প্রক্টরের অনেক গুণ’। সমাবেশে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাদকে সয়লাব ও মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেভাবে মাদকসেবীদের আড্ডা বজায় রয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের সামান্যতম পদক্ষেপ তারা লক্ষ্য করেননি।
ছাত্রদলে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, সাম্যর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের ও বিচার দাবি করছেন। একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যিনি নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেজন্য তার পদত্যাগ দাবি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনোভাবে এ ঘটনার দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আইনশৃঙ্খলার চরমভাবে অবনতি হচ্ছে।
ঢাবিতে শোক দিবস পালন: শাহরিয়ার আলম সাম্যর মৃত্যুতে আজ ঢাবিতে শোক দিবস পালন ও অর্ধদিবস ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে শাহরিয়ার আলম সাম্যর মৃত্যু আমাদের জন্য বেদনাদায়ক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানকে মাথায় রেখে এর নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দায়িত্বে আছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। তবুও আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে চেষ্টা করেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজু ভাস্কর্যের পেছনের গেট বন্ধ করতে। বহিরাগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করেছি। কিছু সফলতা এসেছে কাজে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর একটু সহযোগিতা পেলে আরও কার্যকর সফলতা পাওয়া যেত। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রসঙ্গে উপাচার্য আরও বলেন, আমরা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ডিএমপি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে মিটিং করে তাদের সাহায্য চেয়েছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পেছনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটটি বন্ধ করে ওখানে দেওয়াল তুলে দেওয়া হবে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডিও সাহায্য করবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত লাইটিং ও সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হবে। এগুলো মনিটরিং করবে গণপূর্ত বিভাগ ও ডিএমপি।
সত্যকে আড়াল করার পাঁয়তারা: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাম্য হত্যাকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টর স্যারের সঙ্গে অসভ্য আচরণের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। সামাজিকমাধ্যমে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি অভিযোগ তুলেছেন। সারজিস আলম বলেন, ‘আমাদের ভাই সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টর স্যারের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে এবং তাদের ওপরে দায় চাপানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে সেটা স্রেফ অপচেষ্টা এবং সত্যকে আড়াল করার পাঁয়তারা।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমত, ঘটনা ঘটেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শৃঙ্খলার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নয়। দ্বিতীয়ত, এই উদ্যানের মাদক সেবন, হেনস্তা, চাঁদাবাজিসহ যাবতীয় অপকর্ম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয় বরং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কিংবা প্রভাব খাটানো বিভিন্ন সংগঠন এবং তাদের ছত্রছায়ায় থাকা বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে থাকে।’ এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক বলেন, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এগুলো উচ্ছেদ করতে যায় তখন তাদের বাধা দেওয়া হয়, ক্ষমতার দাপট দেখানো হয়। উদ্যানের গেট যখন বন্ধ করা হলো তখন এই গেট খুলে যারা গেটের ভেতরে ও বাইরে পঞ্চাশের অধিক দোকান বসিয়েছে তারা এই হত্যার পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে অন্যতম দায়ী।’ সর্বশেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাই সাম্যের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সাম্যের মতো আর কোনো ভাইকে যেন হারাতে না হয় কিংবা কারও গায়ে আঘাত না লাগে তার যথাযথ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অনতিবিলম্বে কার্যকর দেখতে চাই।’
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার নিহত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন।
সাম্য হত্যার ঘটনা নিয়ে পুলিশের বর্ণনা: ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শাহরিয়ার গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুই বন্ধুকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। রমনা কালীমন্দিরের উত্তর পাশে বটগাছসংলগ্ন পুরোনো ফোয়ারার কাছে আসার পর অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জন তাদের মোটরসাইকেল দিয়ে শাহরিয়ারের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে ‘দুষ্কৃতকারীদের’ বাগ্?বিতণ্ডা শুরু হয়। বাগ্?বিতণ্ডের একপর্যায়ে ‘দুষ্কৃতকারীরা’ শাহরিয়ার ও তার বন্ধুদের ইট দিয়ে আঘাত করে আহত করেন। একজন শাহরিয়ারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ডান পায়ের ঊরুর পেছন দিকে আঘাত করেন। এতে তিনি রক্তাক্ত হয়ে জখম অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান। এসময় ‘দুষ্কৃতকারীরা’ শাহরিয়ার ও তার বন্ধুদের হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে শাহরিয়ারকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় শাহরিয়ারের বড় ভাই এস এ এম শরিফুল আলম শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হত্যকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনজন আসামি তামিম হাওলাদার (৩০), সম্রাট মল্লিক (২৮) ও পলাশ সরদার (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়।