জীবন বাঁচার তাগিদে বছরে বছরে নতুন নতুন মুখ যোগ হচ্ছে ঢাকায়। আয়ের উৎস হিসেবে সরকারি-বেসরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন ধরনের পেশা বেছে নিচ্ছেন মানুষ। মানুষের চাপের মধ্যেই বেড়েছে গাড়ির চাপ। এসব চাপের মধ্যেই বঞ্চিত-বৈষম্যের শিকারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করছেন ছাত্র, শিক্ষক, নার্সসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সড়কের ওপর তাদের আন্দোলন, মিছিল ও বিক্ষোভের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। বাড়ছে ভোগান্তি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস ছিল। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যানজট তুলনামূলক বেশি থাকে। এর মধ্যে কাকরাইল মোড়ে সড়ক অবরোধ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। এতে আশপাশের সড়কগুলোতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।
বহু আগে থেকে রাজধানীর সড়ক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিছু দাবি-দাওয়ার প্রয়োজন হলেই সড়ক অবরোধ করা হচ্ছে। যার কারণে, কর্মজীবী মানুষ গাড়িতে চলাচল করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ছেন। তেমনি গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যস্ততম এলাকা বাংলাদেশ সচিবালয়ের চারপাশ, প্রেসক্লাবের সামনে, শাহবাগ, টিএসসি পল্টন মোড়, মৎস্য ভবনসহ প্রায় ১০টি পয়েন্টে আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে নানা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে বিক্ষোভ, বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো এবং দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে নগরভবনের সামনে বিক্ষোভ করা হয়েছে। এছাড়াও গত বুধবার ডিপ্লোমাকে ডিগ্রির মান দেওয়ার দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন কয়েক হাজার নার্সিং শিক্ষার্থী। এতে আশপাশের সব সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মসজিদের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছেন। আন্দোলনে কাকরাইল গির্জার সামনের মোড় থেকে কাকরাইল মসজিদ মোড় হয়ে মৎস্য ভবন মোড় পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়েছে। ফলে কোনো যানবাহন কাকরাইল মোড় থেকে সরাসরি হেয়ার রোড দিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হয়ে বাংলামোটরের দিকে কিংবা মৎস্য ভবন মোড় দিয়ে শাহবাগ বা গুলিস্তানের দিকে যাতায়াত করতে পারছে না। যানবাহনের চাপ বেড়ে যায় বীরউত্তম শামসুল আলম সড়ক, মগবাজার রোড, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, বীরউত্তম জিয়াউর রহমান সড়ক ও ভিআইপি রোডে। প্রতিটি সড়কে দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে যায় গাড়ি। মৎস্য ভবন ও কাকরাইল মোড়ের পাশাপাশি আগারগাঁও, মহাখালী, উড়োজাহাজ ক্রসিং, বিজয় সরণি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মালিবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিলজুড়ে তীব্র যানজট তৈরি হয়। যাত্রীদের অনেকেই বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন। পল্টন মোড়ে বেশকিছু মোটরসাইকেল চালক যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। রফিকুল ইসলাম নামের একযাত্রী মহাখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি করছেন। এসময়ে তিনি বলেন, বাস চলছেই না। কাকরাইল সড়ক বন্ধ। বাধ্য হয়ে মোরসাইকেলে রওনা দিতে হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জানান, কাকরাইলে সড়ক অবরোধের কারণে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনে শাহবাগ, প্রেসক্লাবসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে আন্দোলনে নামে আনসারের সদস্যরা। ২৫ আগস্ট সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ করে রাখে সচিবালয়। রাজধানীতে ৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় ৮ মাসে দুইশ’র কাছাকাছি আন্দোলন, বিক্ষোভ ও মিছিল হয়েছে। এখন টানা দুই দিন ধরে আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক শাহবাগ, মৎস্যভবন ও কাকরাইল এলাকায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাক্তন শিক্ষার্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝে না দেওয়া পর্যন্ত ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে টানা আন্দোলন চালানোর ঘোষাণা দিয়েছেন ইশরাকের সমর্থকরা। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৯টা থেকে নগর ভবনের সামনে অবস্থান করেছেন আন্দোলনকারীরা। বেলা ১১টার পর তারা নগর ভবনের ভেতরে অবস্থান নেন। হাজারো অন্দোলনকারীর অবস্থান কর্মসূচি থেকে নানা স্লোগান দেন। এসব স্লোগানের মধ্যে ছিল ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা চলবে চলবে না’, ‘জনতার মেয়র ইশরাক ভাই’, ‘আমাদের মেয়র আমরাই বানাব’ ইত্যাদি। ঘোষণা অনুযায়ী, আন্দোলনকারীরা কাল শনিবার সকাল ১০টায় নগর ভবন থেকে প্রেসক্লাব হয়ে সচিবালয় পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করবেন।
মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব নাহিদ পল্টন মোড়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। শাহবাগ ও মৎস্যভবন মোড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সড়ক অবরোধের বিষয়টি মাথায় রেখেই আগারগাঁও থেকে মেট্রোরেলে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারলেও বেলা ১১টার দিকে অফিসের কাজে তেজগাঁওয়ের উদ্দেশে বের হন। সেখানেই তার বিপত্তি শুরু হয়। মৎস্যভবন ও কাকরাইল মোড় সড়ক বন্ধ থাকায় প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের সড়কে দীর্ঘ যানজট থাকায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর কূলকিনারা না পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন তিনি। নাহিদ বলেন, ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী বহু বছর আগে থেকেই হয়েছে, কিন্তু আমাদের কাজের তো কোনো বিকল্প পথ নেই। বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে, এই অনুপযোগী শহরে বসবাস করতে হচ্ছে। আর আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধ করায় সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শুধু আহসান হাবিব নাহিদ নয়, এমন লাখ লাখ মানুষ যানজটে আটকা পড়েন, বাধ্য হয়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান।
আবাসন ভাতাসহ তিন দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গত বুধবার থেকে মৎস্যভবন, কাকরাইল সড়কে যান চলাচল বন্ধ। এরমধ্যেই দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সামনে বুধবার বিকালে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও গতকাল আবার অবস্থান নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। যে কারণে সকাল ৮টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়ে যানজট। সময় যতই বাড়তে থাকে রাজধানীজুড়ে যানজটের মাত্রা ততই বাড়ে। বিকাল ৫টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস একসঙ্গে ছুটি হওয়ায় সড়কে যানজটের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
কাকরাইল মোড়ে কাজী রাশেদুল হক বলেন, প্রেসক্লাব থেকে রিকশাচালক প্রথমে সেগুনবাগিচা দিয়ে আসছিলেন। যানজট দেখে ভেতরের আরেকটি সড়ক দিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছু দূর এগিয়ে আবার যানজট আটকে পড়তে হয়। সেখানে প্রায় ৩০ মিনিট রিকশায় বসে ছিলেন। দেরি হচ্ছে দেখে নেমে হাঁটা শুরু করেছেন। কাকরাইল মোড় থেকে কিছু দূর হেঁটে আবার রিকশা নিতে হবে। আন্দোলনরত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দাবি না মানা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তিন দফা দাবি আদায়ে গত বুধবার সকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লংমার্চ করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কাকরাইল মোড়ে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এরপর বেলা ২টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে গুলিস্তানেও সড়ক বন্ধ। এর চাপ পড়েছে তেজগাঁওয়ের বিভিন্ন সড়কে। সড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
ট্রাফিক রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার। এ দিনে সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকে, এরমধ্যেই ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দুটি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ। এতে সড়কের অধিকাংশ স্থানে যানজট তৈরি করেছে। অফিসগামী যাত্রী, পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় বিভিন্ন পয়েন্টে ডাইভারশন করা হয়েছে। গুলিস্তান-মতিঝিল গন্তব্য হলে নীলক্ষেত নিউমার্কেট সড়ক ব্যবহারের অনুরোধ জানান তিনি।