ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শাটডাউন’ ঘোষণা

* দাবি আদায় না করে আমরা ঘরে ফিরব না : রইছ উদ্দীন * জবি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে গড়িমসি কেন, প্রশ্ন সারজিসের
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শাটডাউন’ ঘোষণা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসনবৃত্তি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করার ৩ দফা দাবিতে কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। ওই ৩ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ‘শাটডাউন’এর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা চলবে না। রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে চলমান অবস্থান কর্মসূচিতে গতকাল বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ উদ্দীন এ ঘোষণা দেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুর ২টার দিকে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের অধিকার চাইতে, আমাদের দাবি আদায়ের জন্য এসেছি। দাবি আদায় না করে আমরা ঘরে ফিরব না।’

অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিগুলো যৌক্তিক। কিন্তু সরকার আদৌ আছে কি না বুঝতে পারছি না। দুই দিন হয়ে গেল, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রেসপন্স আসেনি।

তিনি বলেন, এই সরকার জুলাই আন্দোলনের ওপর তৈরি হওয়া সরকার। এখানকার প্রতিটি শিক্ষার্থী জুলাই বিপ্লবী। সুতরাং আমাদের হুমকি দিয়ে লাভ নেই। আমরা ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়েছি, কাউকে উপদেষ্টা বানানোর জন্য আন্দোলন করিনি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।

অধ্যাপক রইছ উদ্?দীন বলেন, ‘আমরা কারও বিরুদ্ধে এখানে কথা বলতে আসিনি; কোনো ষড়যন্ত্র করতে আসেনি। আমরা এখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায্য অধিকার নিয়ে এসেছি। আমাদের ওপর পুলিশ নির্বিচার হামলা চালিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অরাজকতা এবং অন্যায়।’ এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা ভালো হবে না বলে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে কোনো শিক্ষার্থীকে কেউ আঘাত করতে পারবে না।’

এর আগে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ইনস্টিটিউট ও বিভাগের পরীক্ষা অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হলো। এদিকে পুলিশের হামলার বিচার ও তিন দফা দাবিতে কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত ২৪টি বাস কাকরাইল মোড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তারা আন্দোলনস্থলে যান।

কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য চত্বরের সামনে থেকে লংমার্চ শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লংমার্চ কাকরাইল মসজিদের সামনে পৌঁছালে বাধা দেয় পুলিশ।

এসময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের দেয়া ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। এসময় প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হন বলে আন্দোলনকারীরা জানান। পরে শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকাল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বাসে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন কয়েকশ’ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। রাত ১০টার পর অবস্থান কর্মসূচিতে আসেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এসময় তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুতই প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করবেন। বৈঠকে শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির বিষয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনের বিষয়ে সরকার কথা শুনবে। তবে রাত ১২টার পর আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সদস্যসচিব শামসুল আরেফিন। তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা (মাহফুজ আলম) যে ব্রিফিং করেছেন, সেটি আরেকটি অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া আমরা কোনোভাবেই এই জায়গা ছেড়ে যাব না।’

এদিকে, আন্দোলনকারীদের অবস্থানের কারণে কাকরাইল মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কাকরাইল মোড় থেকে পল্টনের দিকের সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। গতকাল সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তারা আন্দোলনে যোগ দেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে অন্তত ২৪টি বাস কাকরাইল মোড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তারা আন্দোলনস্থলে যান। দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে চলমান আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এরইমধ্যে অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

জামালপুর থেকে আসা মুকুল হোসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, গতকাল যা হয়েছে, সেজন্য না এসে থাকতে পারছেন না। একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আঘাত সহ্য করতে পারছেন না। চট্টগ্রাম থেকে আসা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী একরামুল হক এরফান বলেন, ‘গতকাল দুপুরের দিকে যখন লাইভে দেখলাম আমার শিক্ষক, ভাইদের ওপর পুলিশ হামলা চালাচ্ছে, তখন আর স্থির থাকতে পারলাম না। অফিস শেষ করে সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। ভোর ৪টায় ঢাকায় নেমেছি। ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা যাব না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সদস্যসচিব শামসুল আরেফিন বলেন, ‘সকাল থেকে বাসে করে শিক্ষার্থীরা আমাদের আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্রাকার বাস চালু আছে, শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হলেই বাসে করে নিয়ে আসা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও এসে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন।’

এদিকে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের থামিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় ভুয়া ভুয়া স্লোগান দেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এ ঘটনা ঘটে। পরে শিক্ষক ও সিনিয়র শিক্ষার্থীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। বর্তমানে বিক্ষোভকারীরা আবারও বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয় স্লোগান দেন। চলে বিপ্লবী গান ও কবিতা পাঠ। এর আগে, তিন দফা দাবিতে গত বুধবার দুপুর পৌনে ১২টায় জবি শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে রওনা হন। পদযাত্রা প্রথমে গুলিস্তান মাজার গেটে বাধার সম্মুখীন হয়। পরে মৎস্য ভবনে আবারও পুলিশের বাধা অতিক্রম করে যমুনা অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। তাদের পদযাত্রা কাকরাইল মসজিদ ক্রসিং মোড়ে আসতেই টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, গরম পানি নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হন। গত বুধবার সারা রাত বিক্ষোভকারীরা যমুনার সামনে অবস্থান করেন।

জবি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে গড়িমসি কেন, প্রশ্ন সারজিসের : প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে লং মার্চ করা ও রাতভর রাস্তায় অবস্থান নেওয়ার পরও কেন তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়া হলো না; কেন আবারও রাস্তায় নামতে হলো শিক্ষার্থীদের? সেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন সারজিস। যেখানে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো অতিদ্রুত মেনে নিয়ে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সারজিস তার পোস্টে লিখেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিতে এত গড়িমসি কেন? তাদের আবার রাস্তায় নামতে হলো কেন?’

সারজিস আরও বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে পুরো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাষ করা হয়েছে। অথচ ঢাকার বুকে দেশের প্রথমসারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসিক হল নেই। মেয়েদের জন্য নামমাত্র একটি আবাসিক হল আছে। একাডেমিক স্পেসও চাহিদার তুলনায় নেই বললেই চলে।’ শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের কথা তুলে ধরে সারজিস লিখেন, ‘যেই সদরঘাট এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত সেটি ঢাকার বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী একটি জায়গা। সেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী কীভাবে থাকবে কিংবা থাকে এগুলো নিয়ে কি কারও মাথাব্যথা নেই?’

আওয়ামী লীগ পতন হওয়ার পরও কেন এখনও এই সমস্যাগুলোর সমাধান হলো না সেই প্রশ্ন তুলে সারজিস লিখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের অনেক জায়গা এবং ভবন এতদিন ধরে দখল করেছিল আওয়ামী লীগের দখলদাররা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত