ঢাবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে ছাত্রদল। সাম্য হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে কালোব্যাজ ধারণ ও অবস্থান কর্মসূচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে এই কর্মসূচি পালন করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে উপাচার্য বাসভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করেন তারা। কর্মসূচিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, ঢাবি শাখা ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস, সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনটির মহানগরের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে। এসময় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ‘আমাদের অঙ্গীকার, নিরাপদ ক্যাম্পাস’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’, ‘ফাঁসি ফাঁসি চাই, হত্যাকারীর ফাঁসি চাই’, ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই’, ‘সাম্য ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেত দেব না’, ‘ক্যাম্পাসে লাশ পড়ে, প্রশাসন কী করে’ সহ নানা স্লোগান দেন।
সমাবেশে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সম্মানিত মানুষ। তিনি শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করবেন। সাম্য হত্যার কোনো খুনির গায়ে ছাত্রদলের কেউ হাত দেয়নি। আমরা মব জাস্টিসে বিশ্বাসী নয়। এসময় তিনি ঢাবির ভিসির পদত্যাগ দাবি করেন।’ নিহত শাহরিয়ার আলম সাম্যের আত্মার মাগফেরাত কামনায় আজ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদের আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, সাম্য নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অর্ধদিবস ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখা ও শোক পালনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে পূর্ণদিবস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ছাত্রদল ও বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনগুলোতে তালা দিয়েছে। এদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রদল ও বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ভবনে তালা দেন। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে তারা রেজিস্ট্রার ভবনেও তালা লাগিয়ে দেন।
এর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাম্য হত্যার ঘটনায় শোক জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার অর্ধদিবসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা এবং শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বিচারের দাবিতে পূর্ণদিবস ধর্মঘটের ডাক দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক আবিদুর রহমান মিশু বলেন, ‘আমরা উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সাম্যর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এই তালা দিয়েছি।’ তিনি আরও জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি চলবে।
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে- রিজভী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত এক মানববন্ধনে তিনি এ মন্তব্য করেন। রুহুল কবির রিজভী বলেন, অবিলম্বে সাম্য হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
শাহবাগে জাতীয় সংগীত বন্ধের আন্দোলনের বিরুদ্ধে সাম্য একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটাই কী তাকে হত্যার কারণ? বিগত ১৬ বছর ছাত্রলীগের নিপীড়ন-নির্যাতন দেখেছি। এখন তো তারা নেই। তাহলে এখনও কেন ক্যাম্পাসে ছাত্রদের রক্ত ঝরছে?
বিএনপির এই সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, পুলিশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে হবে। এসময় কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা আদর্শের মানুষকে বিশেষ সুবিধা দিলে তার পরিণতি ভালো হবে না বলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ারি দেন রিজভী।
সাম্য হত্যাকাণ্ডে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে- উপদেষ্টা আসিফ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
আসিফ মাহমুদ তার ভেরিফাইড ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এরইমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।’
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে এক আতঙ্কের স্থান থেকে ধীরে ধীরে একটি নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক স্থানে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।’
সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ফেসবুক পোস্টে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান। সিদ্ধান্তগুলো হলো- ১. রাত ৮টার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। ২. বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট স্থায়ীভাবে বন্ধ করা। ৩. উদ্যানে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, মাদক ব্যবসা বন্ধ এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা। ৪. নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযানের জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন। ৫. উদ্যানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলোর নিয়মিত মনিটরিং করা। ৬. উদ্যানে একটি ডেডিকেটেড পুলিশ বক্স স্থাপন। ৭. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও রমনা পার্কের মতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা চালু করা।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত এই বিক্ষোভে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাড়াও তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ, নিউমার্কেট থানা ছাত্রদল, মহানগর ছাত্রদলসহ বহিরাগতরা যোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন যে, ছাত্রদল ক্যাম্পাসে বহিরাগত এনে সমাবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করছে।
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যে বহিরাগতদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারালেন, সেই বহিরাগতকেই আবার এই প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলো কেন? আপনারা বুঝতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্নিহিত স্পন্দন- এই ক্যাম্পাসের হৃদয়ের স্ফুলিঙ্গকে ধরতে আপনাদের ব্যর্থতা পরিষ্কার।’
আরেকজন শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘যে বহিরাগতদের কারণে সাম্য ভাই খুন হলো, সেই বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে এনে ছাত্রদল সাম্য হত্যার প্রতিবাদ করছে- বাহ!’ প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্যার এএফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্য। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। নিহত সাম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানা এলাকায়। এদিকে, সাম্য হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাম্যের বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।