বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর দ্বিতীয় দিনেও দেশে ডলারের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। আমদানি এলসির (ঋণপত্র) জন্য অধিকাংশ ব্যাংক গতকাল ডলার ১২২ টাকায় লেনদেন করেছে। গতকাল ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি প্রধানদের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে দুইটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ১২২ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনেছে। তারা জানিয়েছে, লাভের বিষয়টি বিবেচনা না করে গ্রাহকের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এক ট্রেজারিপ্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওই দিন কোনো মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ব্যাংকারদের ভাষ্য, ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, ফলে ডলারের সরবরাহও যথেষ্ট রয়েছে। এ কারণে বাজারে কোনো অস্বাভাবিকতা বা ডলার সংকট দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, এর আগের দিন (১৪ মে) বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর ঘোষণা দেয়। এর আওতায় ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে দর-দাম আলোচনা করে ডলার লেনদেন করতে পারবে, যা আইএমএফের শর্ত পূরণের একটি অংশ। তবে বাজারভিত্তিক হার চালু হলেও এখনও একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বিনিময় হার বজায় রাখতে হবে- এমন একটি ‘অঘোষিত ব্যান্ড’ থাকছে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে বাজারে হস্তক্ষেপ করবে- ডলার কিনবে বা বিক্রি করবে। এর আগে, ডলারের ক্রয় ও বিক্রয় দরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ টাকার ব্যবধান রাখার নির্দেশনা ছিল। ১৩ মে জারি করা একটি সার্কুলারের মাধ্যমে সেটিও বাতিল করা হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরেই ব্যাংকগুলো ১২২ থেকে ১২২.৫০ টাকা দরে ডলার লেনদেন করে আসছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর পরও আপাতত সেই দামেই স্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত বাজারভিত্তিক হার কার্যকর করতে হলে স্বচ্ছ ও নমনীয় নীতিমালার প্রয়োজন, যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
ডলারের দাম বেশি বাড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে- ডেপুটি গভর্নর: সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশের যে সদিচ্ছা আছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেই বার্তা দিতেই ডলারের দাম ‘বাজারভিত্তিক’ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে ডলারের দাম বেশি বেড়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে ‘সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে মাসিক বিশ্লেষণ’ (এমএমআই) শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এখন থেকে প্রতি মাসে এমএমআই আয়োজন করবে পিআরআই। আজ এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন পিআরআই চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার। ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিনিময় হার ‘বাজারভিত্তিক’ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নানাভাবে সহায়ক হবে। সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশের যে সদিচ্ছা আছে, সংস্কারের যে তাগিদ আমরা অনুভব করছি, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা যাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির বহিস্থ খাত যে ভালো আছে, তা-ও বোঝা যাবে।’ হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পর গতকাল বুধবার টাকার বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করলেও সেভাবে অবমূল্যায়ন হয়নি। অর্থাৎ অবমূল্যায়নের চাপ দেখা যায়নি। আরও দুয়েক দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। তখন বোঝা যাবে, কী হতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সুন্দর ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। ফলে টাকার বিনিময় হারের অনাকাঙ্ক্ষিত অবমূল্যায়ন বা চাপ আসবে বলে তিনি মনে করেন না। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার পর্যবেক্ষণ করবে জানিয়েছেন হাবিবুর রহমান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে টাকার বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাহলে হস্তক্ষেপ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সেই হাতিয়ার আছে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, উন্নয়নের জন্য খুব বেশি সংস্কার প্রয়োজন হয় না। জাপানের অর্থনীতি মাত্র ১৫ বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এভাবে এশিয়া অঞ্চলের অনেক দেশের অর্থনীতি ১০-১৫ বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং সঠিক নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং সেগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয় থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক খুরশীদ আলম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাইদি সাত্তার ও পিআরআইয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান। জাইদি সাত্তার বৈদেশিক খাত ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পটভূমি নিয়ে আলোচনা করেন।
মূল প্রবন্ধে আশিকুর রহমান বলেন, অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে; কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এই পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতার উৎস মূলত অর্থ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এই দুর্বলতা দূর করতে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথক করা এবং বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা সংস্কারের বড় দুটি উদ্যোগ।
আশিকুর রহমানের আশা, ‘এসব সংস্কার মধ্য মেয়াদে ইতিবাচক ফল বয়ে আনলে আমরা যে নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের সমস্যায় আছি, তা কাটিয়ে উঠতে পারব এবং অর্থনীতি আরও ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনের উপ-প্রধান ক্লিনটন পবকে ও দ্বিতীয় সচিব জোশুয়া গ্যাসুটান।