ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উচ্ছেদ ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে আরেকটি নাকবা পার করলেন ফিলিস্তিনিরা

উচ্ছেদ ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে আরেকটি নাকবা পার করলেন ফিলিস্তিনিরা

সাত দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও নাকবার স্মৃতি তাড়া করে ফেরে ফিলিস্তিনিদের। গত বৃহস্পতিবার (আবারও আরেকটি বছর ঘুরে আগত নাকবার দিনে গৃহত্যাগের যন্ত্রণা ও প্রাণনাশের শঙ্কায় পার করেছেন গাজা ও পশ্চিম তীরের অধিবাসীরা। নাকবা দিবসের ৭৭তম বছরে গাজায় ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে অন্তত ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকায় গতকাল ভোরের দিকে চালানো হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬১ জন। উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়ায় আল তাওবাহ চিকিৎসাকেন্দ্রে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আরও অন্তত ১৫ জনের প্রাণ গেছে। আরবি নাকবা শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে বিপর্যয়। জাতি হিসেবে ফিলিস্তিনিদের গত ৭৭ বছরের অভিজ্ঞতা সংজ্ঞায়িত করতে এই দিনটি সবচেয়ে সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। আজও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সংঘাতপূর্ণ সম্পর্কের পেছনে এই ক্ষত এক বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। চলমান গাজা যুদ্ধ এবং পশ্চিম তীরের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি আগ্রাসনে নাকবার দুঃসহ স্মৃতি আরও বেশি আতঙ্কিত করে তুলেছে ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর বিতাড়িত ফিলিস্তিনিদের বংশধরদের বিশাল অংশ এখন উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করছেন। ১৯৪৮ সালে জাফা শহর থেকে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে গাজায় আসেন বাদরিয়া মোহারেব। তখন তিনি নিতান্তই শিশু। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে বসবাস করছেন, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী আবারও অভিযান চালাচ্ছে। ইসরায়েলি হামলায় তার দুই নাতি নিহত হয়েছে এবং ঘরবাড়ি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। মোহারেব বলেন, এই যুদ্ধের মতো ভয়াবহ কিছু কখনও দেখিনি। মানুষ একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সূচনা স্মরণ করিয়ে দেয় নাকবা দিবস। তৎকালীন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ব্রিটিশ শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান হওয়ার পরই ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটি নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার পরদিনই একযোগে হামলা চালায় আরব দেশগুলো। কয়েক মাস ধরে চলা ওই যুদ্ধে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তাদের গ্রামগুলোতে এখন ইসরায়েলি বসতি স্থাপিত হয়েছে।

বর্তমান সংঘাতের সূচনা হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই হামাস নির্মূলের উদ্দেশ্য সামনে রেখে গাজায় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে নেতানিয়াহু সরকার। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা নো গো এরিয়ার আওতায় পড়ে গেছে। গাজা উপত্যকার সীমানা বরাবর এবং ইসরায়েলি বাহিনীর উচ্ছেদের আদেশ আওতাধীন এসব এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। গত মার্চ থেকে অন্তত চার লাখ ৩৬ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।

একদিনে ১৪৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ১৪৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। এর ফলে উপত্যকাটিতে মোট মৃতের সংখ্যা ৫৩ হাজার ছাড়িয়েছে। গতকাল শুক্রবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এবং তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু পৃথকভাবে এই তথ্য জানিয়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে আল-তাওবাহ ক্লিনিকে হামলায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।

আনাদোলু তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলায় মোট ৫৩ হাজার ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৫২ জন আহত হয়েছেন এবং মোট আহতের সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৮ জনে দাঁড়িয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বহু মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন এবং উদ্ধারকর্মীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।

উল্লেখ্য, দীর্ঘ ১৫ মাস পর আন্তর্জাতিক চাপে গত ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। তবে, গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে মতানৈক্যের জেরে গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল পুনরায় বিমান হামলা শুরু করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৭৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ৮ হাজার জন আহত হয়েছেন। এই হামলা জানুয়ারির যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং সেখানকার অধিকাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে, গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অধিকন্তু, ইসরায়েল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে আগ্রাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার সম্মুখীন হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত