ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে পুশইন

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে পুশইন

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বিপাকে আছে বাংলাদেশ। আবার নতুন করে অন্তত ৩৭০ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে (পুশইন) ভারত। আরও শতাধিক মানুষকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পুশইনের পরিকল্পনা করছে দেশটি। যা নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে সীমান্তবর্তী জনগণের নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নীতি লঙ্ঘন করে জোরপূর্বক প্রায় ৩৭০ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে। এরমধ্যে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, শান্তিপুর ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১২৩ জন, কুড়িগ্রাম ৪৬ জন, ঠাকুরগাঁও ১৭ জন, সিলেট ২৩ জন, মৌলভীবাজার ১৫ জন, চুয়াডাঙ্গা ১০ জন এবং বাকি ১৩৬ জনকে বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পুশইন করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল আটকৃত ১৭ জনের বিষয়ে দিনাজপুরের হরিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাকারিয়া মণ্ডল বলেন, শনিবার ভোর ৫টার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর সীমান্ত ১৭ জনকে অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশইন করার সময় ৪২ বিজিবির টহল দল তাদের আটক করে।

অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিরা জানান, ভারতের গুজরাটে বাঙালি কলোনি নামে একটি কলোনি ছিল। সেই কলোনি ভেঙে দিয়ে তাদের গুজরাট থেকে বিমানে করে প্রথমে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন বিএসএফ সদস্যরা। তারপর এক ঘণ্টা হাঁটিয়ে সীমান্ত দিয়ে এ পারে ঠেলে দেয়। এই অনুপ্রবেশকারীদের ভেতরে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও রোহিঙ্গা ও গুজরাটি ভাষায় কথা বলা মানুষও ছিল বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত বছরের ৫ আগস্টে ভারতের আশির্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটেছে। সেজন্য সম্প্রতি, ভারতের বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করেছে দেশটি। এবার নতুন করে পুশইন কর্মসূচি নিয়েছে ভারত। দেশটির পরিকল্পিত পদক্ষেপগুলো গভীর উদ্বেগের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

শনিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রায়মঙ্গল নদ ও বয়েসিং খালের সংযোগস্থলে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’-এর উদ্বোধন শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ভারত যেভাবে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ ঠেলে (পুশইন) দিচ্ছে, তা আইনসিদ্ধ নয়। পুশইন সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ সব সময় আন্তর্জাতিক আইন ও প্রটোকল অনুসরণ করে আসছে। আমরা এরইমধ্যে এ সমস্যা সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতকে চিঠি লিখেছি। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশি কেউ যদি অবৈধভাবে ভারতে থেকে থাকেন, তবে ভারত যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠায়। আর বাংলাদেশে যদি অবৈধ ভারতীয় নাগরিক থেকে থাকেন, তাদেরও যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতে ফেরত পাঠানো হবে। সেজন্য ভারতীয় পক্ষকে বলা হয়েছে, তারাও যেন পুশইন না করে যথাযথ চ্যানেলে ফেরত পাঠায়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, গত শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে ভারত পুশইনের চেষ্টা করেছে, যা বিজিবি, আনসার এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় প্রতিহত করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে ও সহযোগিতা করলে ভারত পুশইন করতে পারবে না। ভারত গুজরাটে অবস্থিত একটি বাঙালি বস্তি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে পুশইন শুরু হয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে পুশইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ইউএনএইচসিআর-এর কার্ডধারী কিছু রোহিঙ্গাও রয়েছে। আবার যারা ভারতীয় রোহিঙ্গা, তাদেরও পুশইন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেজন্য আমরা একটা প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি।’ পুশইনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

শ্যামনগরে বিজিবির ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’ উদ্বোধনের পর বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের পুশইন প্রতিরোধে জনগণের সহযোগিতা লাগবে। সীমান্তে বসবাসরত স্থানীয় জনগণ খেয়াল করে বিজিবির টিমকে খবর দিলে টহল টিম দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, মূলত পুশইন যে এলাকাগুলো দিয়ে হচ্ছে এটা সিলেটের বিয়ানীবাজার, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ ওই এলাকায়।

আর এদিকে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, যেদিকে চর এলাকা, প্রত্যন্ত এলাকা, সেদিক দিয়ে মূলত হচ্ছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের যেদিকে জনবসতি নাই সেদিকে কিছুটা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুশইন প্রতিরোধ করার আমরা চেষ্টা করছি। সত্যি কথা বলতে গতকাল (শনিবার) সকালেও কিছু পুশইন হয়েছে। আমাদের বর্ডারটা এত বিস্তৃত, প্রতিটি জায়গা গার্ড করা সম্ভব নয়।

এজন্য আমরা জনগণের সাহায্য চেয়েছি। আনসারের সাহায্য নিচ্ছি। স্থানীয় জনগণও যদি খেয়াল রাখে তাহলে কারও পুশইন করার সুযোগ নেই। ‘পুশইনকে’ নিয়মবহির্ভূত কাজ মন্তব্য করে বিজিবি ডিজি বলেন, আমরা চাই এটা যদি বাংলাদেশি নাগরিক হয়, সেটা যেন একটা নিয়মমাফিকভাবে, আমরা হস্তান্তর-গ্রহণের মাধ্যমে নিতে পারি।

বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এবং সীমান্তে বিজিবির ‘সার্বিক চেষ্টার’ কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ফ্ল্যাগ মিটিং, প্রতিবাদলিপি এবং এ ধরনের রুটিন কাজ যেগুলো আছে, সেগুলো চলছে।

পুশইনের ঘটনা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে গত ৮ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণায় চিঠি পাঠানো হয় ভারতের কাছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এই ধরনের পুশইন গ্রহণযোগ্য নয়। এদিকে কলামিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, পুশইনের ঘটনার আগে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে এসে অনেকগুলো জায়গা তাদের বলে দখল করেছিল। বাংলাদেশের জনগণ বিজিবির সঙ্গে মিলে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সীমান্তে একটা সংঘর্ষ লাগিয়ে তারা প্রমাণ করতে চায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সম্পর্ক হওয়ার কারণে পাকিস্তানি জঙ্গিরা সীমান্তে এসেছে। এমন একটি গল্প তারা তৈরি করতে চায়।

তিনি আরও বলেন, পুশইন বিষয়টিই সম্পূর্ণ মানবাধিকার পরিপন্থি। কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে ঢুকে থাকে, স্বভাবতই তাদের যে আইন আছে সে অনুসারে তাদের বিচার হবে। অথবা বিষয়টি তারা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে জানাবে। এটা না করে পুশইন করাটা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য একটা অপরাধ। ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আওয়ামী লীগের এত এত নেতাকর্মী ওখানে ভারতে আছে। ওরা তো কেউ বৈধভাবে ওখানে যায়নি। ওদের পাঠাচ্ছেন না কেন?’

কূটনীতিক ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতে অবৈধভাবে বাংলাদেশি কেউ থাকলে বাংলাদেশের কাছে ইনফরমেশন পাঠাবে। বাংলাদেশ সরকার সেটা যাচাই করে ইয়েস অর নো জানাবে। আইনে এমনটি আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিয়ম মানতে চায় না ভারত। কাউকে সন্দেহ করলে বাংলাদেশে পুশ করে দেয়। বাংলাদেশের জন্য এটা নতুন এক চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবশ্যই আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে আপত্তি জানানো উচিত।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ভারত সুপরিকল্পিতভাবে মানুষকে পুশইন করাচ্ছে। সীমান্তের ওপারে বহু মানুষকে জড়ো করা হয়েছে। তার মানে ভারত একটা সুপরিকল্পিত সচেতন পদক্ষেপই নিয়েছে। বাংলাদেশের সামনে বিকল্প পথ পুশব্যাক; যেটা আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক।

কিন্তু বাংলাদেশ তো একটা রাষ্ট্র। ফলে এখন পুশইন-পুশব্যাক দুটোই যদি শুরু হয় তাতে সীমান্তে একটা সামরিক উত্তেজনা তৈরি হবে। আর ভারতের এটা অনুমান না করার কোনো কারণ নেই যে, তারা যেটা করছে সেটা সামরিক উত্তেজনা তৈরির প্রথম পদক্ষেপ।

‘জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে’ জড়িত এমন একটি ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৈঠক করার পরামর্শ দেন আলতাফ পারভেজ।

এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিটি কেস আলাদা আলাদাভাবে নিরীক্ষণ করছি। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের দেশের নাগরিক যদি কেউ হয়ে থাকেন, আর সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের আমরা গ্রহণ করব। তবে এটা ফরমাল চ্যানেলে হতে হবে। এভাবে পুশইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়।’

পুশব্যাক: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে অতীতে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, ভারত থেকে এভাবে কয়েক দিনে এত পুশইনের নজির সাম্প্রতিক সময়ে ছাড়া আর কখনও হয়নি। এছাড়া আগে পুশইন করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুশব্যাক (ফেরত পাঠানো) করা হয়েছে; কিন্তু এবার এখনও পুশব্যাক করা হয়নি। তবে, পুশব্যাকের জন্য যাচাই চলমান রেখেছে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত