ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নগর ভবনের সব ফটকে ইশরাকের সমর্থকদের তালা

নগর ভবনের সব ফটকে ইশরাকের সমর্থকদের তালা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও শপথ অনুষ্ঠানে গড়িমসি করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ইশরাক হোসেন জানান, শপথ গ্রহণের দাবিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিএসসিসি নির্বাচনে আমি বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী ছিলাম। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচনি অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিজয়ী হন। ভোটারবিহীন কেন্দ্রে ইভিএম দখল করে ভোটগ্রহণ করা হয়। নির্বাচনের পর দিন, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে, নির্বাচন কমিশন তাপসকে বিজয়ী ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে।

এর বিরুদ্ধে ইশরাক হোসেন স্থানীয় সরকার নির্বাচনি বিধিমালার আওতায় নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। তিনি ওই গেজেট বাতিল করে নিজেকে বৈধ মেয়র ঘোষণা করার আবেদন জানান। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ রায় ঘোষণা করে। রায়ে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের ২০২০ সালের গেজেটটি বাতিল এবং ইশরাক হোসেনকে বৈধভাবে নির্বাচিত মেয়র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এই রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ২০২৪ সালের ২৭ এপ্রিল নতুন গেজেট প্রকাশ করে, যেখানে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইশরাক বলেন, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হলে এবং তার নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হলে, ৩০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু গেজেট প্রকাশের পর প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও শপথ গ্রহণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, আইনের স্পষ্ট বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরব ভূমিকা পালন করছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন অবিলম্বে আমাকে নির্বাচিত মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করেন।

এদিকে ডিএসসিসি প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। এতে নগর ভবন থেকে সেবাসংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল শনিবার সকাল ৯টার দিকে নগর ভবনে প্রবেশের সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে না বসানোর প্রতিবাদে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া তার সমর্থক ও অনুসারীরা এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।

বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন বলেন, তারা নগর ভবনে মোট ৬৫টি তালা লাগিয়েছেন। সরেজমিন তালা লাগানোর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও তার সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে নগর ভবনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তাদের যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানে প্রতিহত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। কর্পোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কার্যত অঘোষিত ছুটি পালন করছেন। তাদের কেউ নগর ভবনে ঢুকতে পারছেন না। নগর ভবনে স্থানীয় সরকার বিভাগেরও অফিস রয়েছে। এখানেই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া অফিস করেন। তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার কারণে এই অফিসেরও সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একাধিক ব্যক্তি বলেন, কর্মসূচি পালনের দ্বিতীয় দিনে গত বৃহস্পতিবারও নগর ভবনের সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিন থেকেই কার্যত নগর ভবন থেকে সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল শনিবার সকাল ৯টার দিকে নগর ভবনের সামনে এসে জড়ো হতে থাকেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। তারা বেলা ১১টা পর্যন্ত নগর ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। বেলা ১১টার দিকে সচিবালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে যান তারা। সচিবালয়ের দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গেলেও চারিদিকে পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে ইশরাকের সমর্থকরা সচিবালয়ের সামনে যেতে পারেননি। বেলা দেড়টার দিকে নগর ভবনের সামনে আগামীকালের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে দিনের কর্মসূচি শেষ করেন বিক্ষোভকারীরা। এসময় অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মশিউর রহমান বলেন, রোববারও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে ‘ঢাকাবাসী’।

আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর ১৮ দিন পর গত বৃহস্পতিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ২০২০ সালের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের দায়েরকৃত নির্বাচনি মামলার রায় ও নির্বাচন কমিশনের আপিল দায়ের না করা বিষয়ে কোনো আইনি জটিলতা আছে কি না, সে বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মাহবুবা আইরিন স্বাক্ষরিত ‘মতামত প্রদানসংক্রান্ত’ শিরোনামে চিঠিটি গত বৃহস্পতিবার আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো একই দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন নগরের বাসিন্দারা। সেদিন নগর ভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে অবস্থান কর্মসূচি চলে। সেই কর্মসূচিতে নগরবাসীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শনিবারও তারা এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিক্ষোভ ও মিছিলে অংশ নেন। নগর ভবনের সামনে অবস্থানকারী বিক্ষোভকারীরা বলেন, এখন পর্যন্ত ইশরাকের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই তারা ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। কেবল নগর ভবন নয়, সংস্থাটির ১০টি আঞ্চলিক অফিসেও সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। একটি অঞ্চলের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইশরাকের সমর্থকরা আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতেও বিক্ষোভ করেছেন। তারা সেখানে কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রবেশ করতে দেননি। শনিবার বেলা ২টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের সামনে মেয়ে ও ভাইকে নিয়ে জুরাইন এলাকা থেকে বাবার মৃত্যুসনদ নিতে এসেছিলেন নাসরিন বেগম। নগর ভবনে তালা লাগিয়ে দেওয়ার কারণে তিনি ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এর আগে গত বৃহস্পতিবারও তিনি বাবার মৃত্যুসনদ নিতে এসেছিলেন। আন্দোলনের কারণে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। আজ এসে দেখছেন সব ফটকে তালা ঝুলছে।

এখন তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। একই সময়ে মোটরসাইকেলে করে গুলশান এলাকা থেকে এক আত্মীয়ের জন্মনিবন্ধনের তথ্য জানতে নগর ভবনে এসেছিলেন শাওন আহমেদ। মূল ফটক তালাবদ্ধ থাকায় তিনি ভেতরে ঢুকতে পারেননি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, দাবির শহর ঢাকায় তাদের মতো সাধারণ মানুষরা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন। এসব ভোগান্তির দ্রুত অবসান চান তারা। এদিকে ডিএসসি মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচিতে পুলিশি বাধার মুখে পরে তার সমর্থকরা। গতকাল শনিবার সাড়ে ১১টার দিকে ডিএসসি ভবনের সামনে থেকে লংমার্চ শুরু হয়। মিছিলটি গুলিস্তান মাজার, জিরো পয়েন্ট, পল্টন হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে সচিবালয়ের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ এতে বাধা দেয়। বাধা পেয়ে মিছিলটি নগর ভবনের সামনে ফিরে আসে। বিক্ষোভকারীরা ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা, চলবে না’, ‘অবিলম্বে ইশরাক হোসেনের শপথ চাই’, ‘জনতার মেয়র ইশরাক ভাই, অন্য কোনো মেয়র নাই’- এমন স্লোগান দেন। ইশরাকের সমর্থকরা আগে থেকেই নগর ভবন থেকে সচিবালয় পর্যন্ত লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে সকালে নগর ভবন অবরুদ্ধ করে তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। পরে নগর ভবন থেকে লংমার্চ শুরু হয়।

এদিন সাধারণ কর্মচারীরাও বিক্ষোভে অংশ নিয়ে নগর ভবনের সব গেট বন্ধ করে দেন। এতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় অচল হয়ে পড়ে। ফলে কোনো সেবাপ্রার্থী বা কর্মকর্তা ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি।

বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ডিএসসিসি ভবনের সামনে থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি গুলিস্তান মাজার, জিরো পয়েন্ট, পল্টন প্রেসক্লাব, শিক্ষাভবন এবং বঙ্গবাজার হয়ে আবার নগর ভবনের সামনে ফিরে আসে। এতে অংশ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকার হাজারো মানুষ। জানা যায়, গত ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির ইশরাক হোসেনকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। তবে গেল ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাপসের বিজয় বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করা হয়। গত ২২ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চায় নির্বাচন কমিশন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত