সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রতিদিন ঢাকায় আন্দোলন-বিক্ষোভ-মিছিল ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি করছে। এতে ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের যাতায়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। গতকাল একদিনেই ঢাকায় অন্তত সাতটি স্থানে বিক্ষোভ-মিছিল করা হয়েছে। ছোট-বড় যে কোনো ইস্যুতে কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে সড়ক অবরোধ করছে। অসহনীয় এ অবস্থা থেকে ঢাকাবাসীর মুক্তি কবে মিলবে, তা কারও জানা নেই।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীরা বেশিরভাগ সময়ে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, গেন্ডারিয়া, মহাখালী, মাহুতটুলী, পিলখানা, এলিফ্যান্ট রোড, ইন্দিরা রোড, কাকরাইল, মৎস্যভবন ও ফার্মগেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় সমাবেশ ও বিক্ষোভ করা হয়। এসব স্থানের যে কোনো একটি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে পুরো ঢাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।
গতকাল বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের দাবিতে নগর ভবনের সামনে থেকে সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল করেন ইশরাকের সমর্থকরা। মিছিলটি গুলিস্তান, সচিবালয়, জাতীয় প্রেসক্লাব, শিক্ষা ভবন হয়ে ফের নগর ভবনের সামনে আসে। বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে গুলিস্তান মাজারের দিক থেকে বঙ্গবাজারের দিকের সড়কের দু’পাশে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রীরা হেঁটে গন্তব্যে যান। একইদিনে শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ঘেরাও করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যা মামলার তদন্তে গাফিলতির প্রতিবাদ এবং এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে প্রায় দুই ঘণ্টা রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো কলম বিরতি কর্মসূচি পালন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পুঁজিবাজারে টানা ধস, অব্যবস্থাপনা এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ায় বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে এই মিছিল করা হয় এবং গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের ৮টি পোশাক কারখানার শ্রমিকের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারত থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিতিশলীতার পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। কোনোভাবেই স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না রাজধানী ঢাকা। যে কোনো ইস্যু নিয়ে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের চারপাশ, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে, শাহবাগসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আন্দোলন, বিক্ষোভ-মিছিল করা হয়। কখনও আনসার, কখনও প্যাডেলচালিত রিকশার চালক, কখনও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, কখনও গার্মেন্ট শ্রমিক, কখনও শিক্ষক-চিকিৎসক-নার্স, কখনও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবী, কখনও পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারী, শিক্ষার্থী-নাট্যকর্মীসহ পেশাজীবীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। নানা দাবিকে ঘিরে কমবেশি প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে খণ্ড খণ্ড আন্দোলন। সর্বশেষ এনবিআর বিলুপ্ত করে নতুন অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন দফা দাবির বিষয়ে সমাধান খুঁজতেই মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে তথ্য নিশ্চিত করেছেন এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল আমিন শেখ।
ঢাকা শহরজুড়ে এমন অনেক আন্দোলন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কখনও আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিচ্ছে শাহবাগে তো আবার কখনও গুলিস্তানের মতো ব্যস্ত জায়গায়। এসবে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে, রাস্তা বন্ধ থাকায় জ্যামের ফাঁদে পড়ছেন অফিসগামীরা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা রাকিব হাসান পুরানা পল্টনে অফিসিয়াল কাজের জন্য আসেন। তিনি বলেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে পল্টনে আসতে হয়েছে। এসব আন্দোলনকে ঘিরে একদিকে যেমন জনসাধারণের ভোগান্তি অন্যদিকে কাজের মানসিকতায় সমস্যা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা পেলেও সাধারণ মানুষ এসব আন্দোলনের কারণে পড়েছেন সীমাহীন ভোগান্তিতে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক বন্ধ করে এসব আন্দোলন হওয়ার কারণে জনসাধারণের দুর্ভোগের শেষ নেই। আন্দোলনকারীদেরও তাই ভাবতে হবে বিষয়টি নিয়ে। সড়ক বন্ধ না করে, জনদুর্ভোগ তৈরি না করে, আন্দোলনকারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি স্থান তৈরি করে দেওয়া উচিত।
সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ ও সমাবেশ কর্মসূচির ফলে সময়মতো কর্মস্থল ও অসুস্থ রোগী দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ঢাকাবাসীরা বলছেন, তারা এ ধরনের মানবসৃষ্টির যানজট থেকে পরিত্রাণ চান। বছরজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশের কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে চান না। সরকার যত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে ততই ঢাকাবাসীর জন্য মঙ্গল। আন্দোলনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সড়ক অচল হয়ে পড়ায় অনেক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও সৃষ্টি হচ্ছে। অতিষ্ঠ নগরবাসীকে অনেক সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে।
মতিঝিলে একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন ফরিদ প্রধান। তিনি বলেন, সড়কের ওপর প্রতিনিয়ত আন্দোলনে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারছি না। আজ এ-রাস্তা বন্ধ তো কাল অন্য রাস্তা বন্ধ। দিনের পর দিন সময় মতো অফিসে পৌঁছাতে না পেরে চাপে আছি। অফিস থেকে নোটিশ পেয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে চাকরি টিকে রাখা কঠিন হবে। আরেকজন নাইমুল ইসলাম বলেন, এখন অফিসে যেতে হাতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় নিয়ে বের হতে হয়। বলাতো যায় না কখন কোথায় গিয়ে আন্দোলনের মধ্যে পড়তে হয়। অফিস তো আর কোনো অজুহাত শুনবে না।
শ্রাবণ পরিবহনের চালক কাজী আজহারুল বলেন, কখনও শাহবাগে আন্দোলন, কখনও প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন আবার কখনও মৎস্যভবন মোড়ে আন্দোলন। এতে সড়কে যানজট তৈরি হয়, গাড়ির তেল খরচ বাড়ে, যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে। গাড়ির তেলের বাড়তি খরচে চালকদের আয় কমে যায়, সংসার চলানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। সড়ক বন্ধ থাকলে গাড়ির চাকাও ঘুরে না। সারাদিন বসে থাকতে হয়। সারাদিন কোনো ট্রিপ মারতে না পারলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে দিনের পর দিন সড়ক বন্ধ করে কর্মসূচি দিলে গরিবের পেট চলবে কীভাবে? এগুলো এখন আর সহ্য করতে পারছি না। একটা দেশ এভাবে চলতে পারে না’- বলেন এ বাসচালক।
সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন না করতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বারবার গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও কার্যত তার কোনো সুফল মিলছে না। আন্দোলনকারীরা এসবে কর্ণপাতও করছেন না। তারা মনে করেন, অচলাবস্থা যত তৈরি হবে, দাবি আদায়ের পথ তত সুগম হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবসময় আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করছি, তারা যেন সড়ক বন্ধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করেন। সবাইকে একটু সহনশীল এবং সংযত আচরণ করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে জানাতে পারেনি। কেউ দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়কে নামলে তাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে এখন তারা তাদের মতো করে মাঠে নামছে। তাদের এই মাঠে নামাটা অযৌক্তিক নয়। তবে দাবি আদায়ের নামে সংঘাত-সহিংসতা, সড়ক অবরোধের ফলে জনদুর্ভোগ তৈরি করাটা দুঃখজনক।