১১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে কক্সবাজার শহরের অলিগলি কাদায় ভরে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতে সড়কে কাদামাটি ও পানি জমে থাকার কারণে ব্যবসায়ী, স্কুল, কলেজপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীসহ শহরমুখী মানুষের মাঝে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। ভারি বর্ষণের আগেই কক্সবাজার শহরের অলিগলির নালাগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ না নিলে বর্ষার মৌসুমে কক্সবাজার শহরে জলবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে গতকাল রোববার কক্সবাজারে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন সভাপতির বক্তব্যে ‘এখন থেকে বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সম্ভাব্য দুর্যোগ ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগাম প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করার আহ্বান জানান।
সভায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুস সাকিব খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইমরান হোসাইন সজীব, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদুল হক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাসান মাসুদসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য রাখেন। এসময় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় কৃষি, স্বাস্থ্য বিভাগ, গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ, অবৈধভাবে সরকারি জমি ও ফুটপাত দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান, জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়।
দুই সপ্তাহ ধরে চলা প্রচণ্ড গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। গতকাল রোববার ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত শহরে টানা বৃষ্টিপাত হয়। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান জানিয়েছেন, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজকে বাকি দিন ও রাতে আবহাওয়া আংশিক মেঘলা থেকে মেঘলা থাকতে পারে। আগামীকাল হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। পরবর্তী ২-৩ দিন এরকম আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি । সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অল্প বৃষ্টিতে কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন জায়গায় নালার পানি রাস্তায় চলে এসেছে। শহরের হোটেল-মোটেল জোনের বাইপাস সড়ক, বাজারঘাটা, টেকপাড়া, গোলদিঘিরপাড়, বিজিবি ক্যাম্প, আলীরজাহালসহ কয়েকটি স্থানে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। কক্সবাজার শহরের অধিকাংশ নালা ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে কাদামাটি একাকার হয়ে জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে প্রবহমান বাঁকখালী নদী। তারই মাঝে অবস্থান পর্যটন শহর কক্সবাজারের। অথচ একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় এ পর্যটন শহরের অর্ধেক এলাকা। বন্যার পানি ঢুকে যায় বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। এতে তৈরি হয় চরম জনভোগান্তি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শুধু নালা পরিষ্কার করলেই জনভোগান্তি কমবে না। এর সঙ্গে জড়িত পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ বাঁকখালী নদীর প্রবাহ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। এসব কাজ বাস্তবায়ন করতে পারলেই আশাকরি জনভোগান্তি কমে আসবে।
কক্সবাজার পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার শহরে জলাবদ্ধতার পেছনে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে কক্সবাজার পৌরসভা। এগুলো হচ্ছে নালা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় কাটা, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা নালায় ফেলার কারণে নালা ভরাট হয়ে যাওয়া এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
স্থানীয় লোকজন জানান, একটু ভারি বর্ষণ হলেই শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদীঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাঁচা মিয়ার ঘোনা ও পাহাড়তলী, শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া, বিজিবি ক্যাম্প এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যার পানি ঢুকে যায় বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় চরম জনভোগান্তি। বিশেষ করে শহরের সাগর তীরবর্তী কলাতলী পর্যটন এলাকায় এ ভোগান্তি চরম আকার নেয় বর্ষা মৌসুমে।
কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল বলেন, গত এক দশকে কক্সবাজার পৌরসভার উন্নয়নে কয়েকশ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ জলাবদ্ধতার মতো মূল সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি। পাশাপাশি পাহাড় কাটার মাটি এসে ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে উন্নয়ন কাজে দুর্নীতি বন্ধের পাশাপাশি পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে।
নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সমৃদ্ধ কক্সবাজারের ভাইস চেয়ারম্যান আদনান সাউদ বলেন, বিগত সরকার কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য কক্সবাজার শহরের সবচেয়ে বড় নালাটি বন্ধ করে দেয়। কক্সবাজার পুরোনো ঝিনুক মার্কেটের সামনের বড় নালাটি দিয়ে পুরো শহরের সিংহভাগ পানি সাগরে যেত। সেই নালাটি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর কুফল এসে পড়েছে পর্যটন জোনে। অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, মূলত পাহাড় কাটার মাটি এসে আমাদের আশপাশের সব ড্রেন ভরাট হয়ে যায়। এছাড়া সড়ক বিভাগ সড়কের সংস্কার করতে গিয়ে পুরনো ৬টি কালভার্ট উঁচু না করেই এর ওপর রাস্তা নির্মাণ করেছে। ফলে এসব কালভার্ট দিয়ে পর্যাপ্ত পানি সরতে পারছে না। হোটেল শৈবালের সামনে দিয়ে যে বড় নালাটি আছে তার দুটি জায়গায় গাড়ি পারাপারের রাস্তা করায় পানিগুলো যেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর এ সমস্যার কারণে পর্যটন জোনে জলাবদ্ধতা হয়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, পর্যটন জোনের জলাবদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কক্সবাজার পৌরসভা, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পর্যটন ব্যবসায়ী, হোটেল মালিকসহ সবাইকে নিয়ে আমি জরুরি সভা করেছি। সবাই যার যার অবস্থান থেকে তার কাজগুলো সবাই মিলে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এরইমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। পাশাপাশি বর্ষা শুরুর আগে গত একমাস ধরে কক্সবাজার পৌরসভার নালাগুলো জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। আমরা চেষ্টা করছি আসন্ন বর্ষার আগেই সব সমস্যা সমাধান করার জন্য।