বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের উন্নয়ন ও বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া জটিল হলেও জোরচেষ্টা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরইমধ্যে বেশকিছু পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনতে বিদ্যমান টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও পলাতক পাচারকারীদের লুটের জব্দকৃত টাকা এবং শেয়ার জনহিতকর কাজে ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান সরকার।
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অপরাধীদের কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়নি, উল্টো পুরস্কৃত করা হয়। আবার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে আমলা ও ব্যবসায়ীরা দুর্নীতি করে বিদেশে অর্থপাচারের সুযোগ পান।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার নতুন কোনো ঘটনা নয়। পাচারকৃত অর্থের অধিকাংশ দুর্নীতি ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এরমধ্যেই গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার এমপি, মন্ত্রী ও সুবিধাভোগী আমলা বিদেশে অর্থ পাচার করেন। বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটিসহ (জিএফআই) বিভিন্ন সংস্থার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় অন্তত ১৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হলেও গতকাল সোমবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে। তবে এক বছরের মধ্যে বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করা যাবে। গভর্নর বলেন, পলাতক পাচারকারীদের লুটের জব্দকৃত টাকা ও শেয়ার দরিদ্রদের জন্য ও জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হবে। এ লক্ষ্যে ফান্ড তৈরি করা হবে। তিনি আরও বলেন, আইনের সঠিক ধারা মেনেই সবকিছু করা হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের গুলশানে থাকা ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি জব্দ করা হয়েছে। ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীর স্ত্রী তারিন হোসেনের নামে গুলশানে থাকা একটি ফ্ল্যাট, গ্যারেজ ও কমনস্পেস জব্দ করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় কুমিল্লা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়ার মালিকানাধীন ১৭ দশমিক ৭৯ একর জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এভাবে পলাতক পাচারকারীদের বহু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এসব জব্দকৃত অর্থ জনকল্যাণে ব্যয়ের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, মাঝারি আকৃতির যারা ২০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব কেসের ক্ষেত্রে বিদেশি আইনি সংস্থার মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সম্ভাব্য ১২৫টি কেস চিহ্নিত করা হয়েছে। এদিন প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিদেশে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনা হয়। শফিকুল আলম বলেন, এই পর্যন্ত ২০টি আইনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও লিটিগেশন ফান্ডের কাছ থেকে আবেদন পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা লিটিগেশন ফান্ড নির্বাচনের মানদ- ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত গাইডলাইন হচ্ছে। আমাদের কাজগুলো আমরা যত দ্রুত করা যায় করছি। কেউ যে খুব শান্তিতে আছে আমরা তা মনে করি না।
প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ হিসাবে এক লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ দশমিক ৭ কোটি টাকা, বৈদেশিক হিসাবে ১৬৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার সংযুক্ত করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ ফ্রিজিং হয়েছে ৪২ হাজার ৬১৪ দশমিক ২৭ কোটি টাকা, বিদেশে ২০ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ ফ্রিজিং করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জব্দ করা লুটের টাকায় একটা ম্যানেজেমেন্টের ফান্ড করতে বলেছেন। এই টাকা ডিপোজিট করা হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় হবে। লুটের টাকার পরিমাণ অনেক। এটিকে বাজেটে বা অন্য কোথাও না এনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লুটের টাকা ম্যানেজমেন্ট ফান্ডে ব্যবহার হবে। এই নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন।
জানা গেছে, বিদেশে অর্থপাচার সবচেয়ে বেশি হয় বাণিজ্যের আড়ালে। আমদানি পণ্যের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানো হয়। আর এসব ঘটনার সঙ্গে অর্থপাচারকারীর সঙ্গে কিছু সহযোগী মানুষ রয়েছেন। যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন।