ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে বসানোর দাবিতে সড়ক অবরোধসহ নগর ভবনের সব ফটকে তালা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মৎস্য ভবনের মোড় ও কাকরাইল মোড়ে যমুনার প্রবেশপথের কাছাকাছি অবস্থান নেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ পেশাজীবী জোটের ব্যানারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করেন বিএনপির একাংশ। গতকাল বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন ইশরাক হোসেনের পক্ষের কর্মসূচির সমন্বয়কারী সাবেক সচিব মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হলে ঢাকা অচলেরও হুমকি দেন তিনি। এই আন্দোলন ও দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সর্বস্তরের কর্মচারী ইউনিয়ন। তারা দাবি মেনে নেওয়া না হলে নাগরিক সেবা বন্ধের হুঁশিয়ারি দেয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলটিমেটামে সাড়া না দিলে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গতকাল মৎস্য ভবন মোড় অবরোধ করা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, গতকাল সকাল ১০টার কিছু সময় পর মৎস্য ভবন এলাকায় জড়ো হতে থাকেন বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঢাকাবাসীর ব্যানারে তারা এই কর্মসূচি পালন করেন। সাড়ে ১০টার দিকে বিক্ষোভকারীরা মৎস্য ভবন মোড়ে অবস্থান নিলে এই পথে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১২টার দিকে মৎস্য ভবন মোড় অবরোধ করার কারণে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেয়। মৎস্য ভবন মোড়ে কামরাঙ্গীরচর থেকে আসা মোহাম্মদ হোসাইন নামের এক ব্যক্তি বলেন, আদালতের রায়ের পরও ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়ে নানা টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এত দিন তারা সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দাবিতে সাড়া না দেওয়ায় রাজপথে নেমেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের সামনেও ইশরাকের পক্ষে বিক্ষোভ হয়। সেখানকার কর্মসূচিতে অংশ নেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারীরা। কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগর ভবনের সব ফটকে তালা ঝুলছে। এজন্য নাগরিকসেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কর্মকর্তারা অঘোষিত ছুটিতে আছেন। নগর ভবনে স্থানীয় সরকার বিভাগেরও কার্যালয় রয়েছে। সেখানে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াও অফিস করতেন। ১৪ মে ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরুর পর স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যালয়ও বন্ধ রয়েছে। ওই দিন থেকে সেখানে আর যাননি উপদেষ্টা আসিফ।
দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগের আহ্বান: অন্তর্বর্তী সরকারের সব দায়িত্ব থেকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও মাহফুজ আলমকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। গতকাল বুধবার ইশরাক হোসেনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এই আহ্বান জানানো হয়। ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- ‘গণতান্ত্রিক ভাষায়, রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে যৌক্তিক কারণে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছি। যেহেতু এটা প্রতীয়মান যে আপনারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, হয়তো আগামিতে সরাসরি যুক্ত হবেন। এবং এটাও অনেকটা স্পষ্ট আপনারা নির্বাচন করবেন। তাহলে আপনাদের পদত্যাগের দাবি কি অযৌক্তিক? নাকি এটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে এবং আপনাদের নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান ঘটবে। ‘আপনাদেরই নাহিদ ইসলাম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছে সেটাই অনুসরণ করুন। উনি চাইলে হয়তো আরও কিছুদিন মন্ত্রীত্ব করে তারপর এনসিপিতে যেতে পারতেন। একটা সময় ছিল সার্জিস আলম হাসনাত আবদুল্লাহরা জোরালোভাবে দাবি করলে ওনারাও হয়তো মন্ত্রিত্ব নিতে পারতেন। কিন্তু তারা রাজনীতি করবেন বলে সেই কর্মপন্থা বেছে নিয়েছেন। হয়তো একদিন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে পূর্ণাঙ্গভাবে মন্ত্রীর দায়িত্ব, ক্ষমতা ও সম্মান আবার পাবেন। ‘আপনারা পদত্যাগ করলে বর্তমান সরকারের নিরপেক্ষতার ইমেজই বৃদ্ধি পাবে। এখনও মনে করি সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দলীয় ও সাংগঠনিক কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে দেশ ও জনগণকে আপনারা আরও ভালো কিছু দিতে পারবেন। ‘আর ক্ষমতা ধরে রাখলে আপনাদের দলের লোকজনকে বিশেষ সুবিধা দিতেই হবে, এটা থেকে বিরত থাকার বা শতভাগ নিরপেক্ষ থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা অথবা ক্ষমতা আপনাদের নেই। কারোরই থাকে না। কাঁঠাল ভাঙবে আপনাদের মাথায়, খাবে কিন্তু অন্য সবাই। ‘এখন নিশ্চয়ই বলবেন বা ভাববেন ক্ষমতার লোভে অবৈধ মেয়র হওয়ার জন্য দিনের পর দিন আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়ে জনভোগান্তি তৈরি করে নিজেকে সাধু বানিয়ে আমাদের নীতিবাক্য শোনাচ্ছেন তাই না? আমি নিজেও কি কম সমালোচনার শিকার হয়েছি এটি করতে গিয়ে? কিন্তু আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আপনাদের যে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে সেটা জনগণকে বোঝানো দেশের জন্য প্রয়োজন ছিল। এবং আজ অবধি আমাকে বাঁধা দেওয়ার কাজটি যৌথ সিদ্ধান্তে হচ্ছে এটা মিনিমাম রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষ বোঝে। কিন্তু আমি বলব এটা ছিল ওনাদের ভুল পলিসি, ব্যবহার হলেন আপনি আসিফ ভূঁইয়া। আইন আদালত মেনে নিতে না পারলে কোথা থেকে দেশ সংস্কার শুরু হবে? তারপর যত ইচ্ছা সমালোচনা করতেন, দেখতেন আসলে কি করি। এখন পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়া আমাকে সম্পন্ন করতেই হবে। ‘বন্দোবস্ত তো আগেরটাই অনুসরণ হচ্ছে। আরও পাকাপোক্ত করা হচ্ছে বললেও ভুল হবে না। আপনাদের পদত্যাগের দাবি থেকে সরার কোনো সুযোগ নেই। আপনারাই বা কেন থাকতে চাচ্ছেন?’
রিটের ওপর আদেশ আজ: ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিটের আদেশ দেবেন আজ হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল শুনানি নিয়ে আদেশের নতুন এ দিন ধার্য করেন। রিটের ওপর শুনানি নিয়ে গত মঙ্গলবার আদালত বুধবার আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। রিটটি আদেশের জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ১১ নম্বর ক্রমিকে ওঠে। ক্রম অনুসারে সাড়ে ১২টার দিকে বিষয়টি উঠলে ইশরাকের আইনজীবী, রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষ শুনানিতে অংশ নেন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে সম্পূরক আবেদন দাখিল করা হয়। বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত শুনানি চলে। এরপর আদালত আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার সকালে সময় নির্ধারণ করেন। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে ইশরাকের করা নির্বাচনি মামলায় চলতি বছরের ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাপসকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করা হয়। ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা হয়। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির পরও কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ইশরাকের সমর্থকরা নগর ভবনের সামনে ১৪ মে থেকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।