ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইশরাকের শপথ নিতে বাধা নেই, আন্দোলন স্থগিত

* ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম * ইশরাককে মেয়র ঘোষণার গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিট সরাসরি খারিজ * ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ালে আদালত অবমাননা হবে : মাহবুব উদ্দিন খোকন * দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি * উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে, বললেন ফখরুল
ইশরাকের শপথ নিতে বাধা নেই, আন্দোলন স্থগিত

ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিটটি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। তার মানে দাঁড়াল, ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য আর কোনো বাধা থাকল না। এমনটি জানিয়েছেন আইনজীবী কায়সার কামাল। এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সহায়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে কাকরাইল মোড়ে আন্দোলনস্থলে এসে এ ঘোষণা দেন। ইশরাক হোসেন বলেন, আইনের শাসনের বিজয় হয়েছে। যেহেতু আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সেহেতু আমরা আশা রাখব সরকার কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করবে। যেহেতু আজ আমরা রায় পেয়েছি, যদি সরকার আবারও টালবাহানা করে, আবার কালক্ষেপণ করে, তাহলে আমরা এখানে এসে আবার জড়ো হবো। তিনি বলেন, হাইকোর্টের আদেশ শোনার পর আমাদের দল থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা আন্দোলন আপাতত স্থগিত রাখব। সরকারকে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখব। এসময়ে তাদের যে কর্মকাণ্ড, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা পরবর্তী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেব। ইশরাক বলেন, আমাদের এ কর্মসূচিগুলোর ফলে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। জনগণ দুর্ভোগে পড়ে। এজন্য আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি আমরা এটাও বলে দিতে চাই, বর্তমান সরকার আমাদের অধিকার বঞ্চিত করতে গিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমরা এমন কর্মসূচিতে নামার সিদ্ধান্ত নিই।

দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ভেতরে যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছেন তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সরাসরি সমর্থক। সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। তাদের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন শেষ হবে না। আমরা সরকারকে পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, আমাদের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন শেষ হবে না।

এর আগে তাকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত বুধবার সকাল থেকে কাকরাইলে অবস্থান নেন তার সমর্থকরা। তারা সারা রাত সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।

গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, বিএনপি নেতাকর্মীরা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবি করে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন। একই সঙ্গে দুই উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি করছেন তারা। যমুনারে যমুনা আমরা কিন্তু যাব না, এই মাত্র খবর এলো ইশরাক ভাই মেয়র হলো, এ মুহূর্তে দরকার নির্বাচিত সরকার, দফা এক দাবি এক নির্বাচিত সরকার, যমুনারে যমুনা শপথ ছাড়া যাব না- বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি সরাসরি খারিজ করেন। পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেওয়া হয়। আদেশের পর আইনজীবী কায়সার কামাল এ কথা বলেন। আদালতে শুনানিতে তিনি রিটের বিরোধিতা করেন।

আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, ‘আমরা মনে করি যে উপদেষ্টা আছেন, যিনি হয়তোবা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিষয়টি ঘোরাচ্ছিলেন, তিনিও এখন অন্তত আজকে রিট খারিজের পর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।’

ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় ও ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে মো. মামুনুর রশিদ নামের সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী ১৩ মে রিটটি করেন।

আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন। নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় ও ফলাফল প্রকাশের গেজেট সমর্থন করে আইনসম্মত উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আইনজীবী কায়সার কামাল শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান ও খান জিয়াউর রহমান শুনানিতে ছিলেন।

২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস।

নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে ইশরাকের করা নির্বাচনি মামলায় চলতি বছরের ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাপসকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করা হয়। ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা হয়।

আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে ইসি। মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির পরও কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ইশরাকের সমর্থকরা বিক্ষোভ শুরু করেন।

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ?‘গড়িমসি না করে এখন সরকারের দায়িত্ব ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করা। হাইকোর্টের আদেশের পরও শপথ না পড়ালে সেটা হবে আদালত অবমাননা। আমরা আশা করি সরকার কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করবে।’

এদিকে, উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, আশা করি সরকার ইশরাক হোসেনকে শপথ দেওয়ার ব্যবস্থা নেবেন। সেইসঙ্গে এ বিষয়ে তিনি আর সড়ক অবরোধ না করে জনগণের স্বস্তির জন্য নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিট হাইকোর্টে খারিজ হওয়ার পর এ প্রতিক্রিয়া জানান মির্জা ফখরুল। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

শায়রুল কবির খান জানান, থাইল্যান্ডের ব্যাংককে চিকিৎসাধীন বিএনপি মহাসচিব তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে। এটাতে নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের আরেকটা বিজয় হয়েছে। আমরা জানি যে, যখন মেয়র নির্বাচন হয় তখন সেটা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জবরদস্তি জোর করে এই ফলাফল কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। জনতার মেয়র হিসেবে ঢাকাবাসীসহ দেশের জনগণ ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করেছিল।’

ইশরাক হোসেনের শপথ দিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি আশা করব যে, মন্ত্রণালয়ে আর কোনো সমস্যা তৈরি না করে দ্রুত তারা ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করবেন এবং পরিস্থিতিকে সহজ করে তুলবার চেষ্টা করবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আবারও বলছি, বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট- এই সংকট দূর করার একটিমাত্র পথ তা হচ্ছে, অতি দ্রুত নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এখানে অন্য কথা বলে লাভ নেই। কারণ, সংস্কারের যে বিষয়টা আছে সেটা চলমান প্রক্রিয়া। চলমান যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করবেন। আর যেসব সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না সেগুলো সনদের ভেতরে নিয়ে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে রাখবেন।’

নেতাকর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি মনে করি যে, যেহেতু আদালতে এ বিষয়ে রায় হয়েছে, জনগণের বিজয় হয়েছে। এখন আর এই বিষয়টাকে সেভাবে সড়ক অবরোধ করে না রেখে... আশা করা যায় যে সরকারের সুমতি হবে- তারা ইশরাককে শপথ দেওয়ার ব্যবস্থা নেবেন। তারা (নেতাকর্মী-সমর্থকরা) জনগণের স্বস্তির জন্য রাস্তা থেকে সরে যাবেন।

গত ১৪ মে চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য ব্যাংকক যান বিএনপি মহাসচিব। পরদিন ব্যাংকক রুটনিন আই হসপিটালে তার বাম চোখে সফল অস্ত্রোপচার হয়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে হাসপাতালে আছেন।

এদিকে মেয়র ঘোষণা নিয়ে রিট খারিজের খবর আসার পর ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে ছাত্র উপদেষ্টারা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের রাস্তায় থাকতে বলেন ইশরাক।

পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আন্দোলনকারী ভাইদের বলব এসব মুলা দিয়ে গাধা বস করা যায় আমাদের নয়। দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের পদত্যাগের খবর না আশা পর্যন্ত চলেছে লড়াই চলবে। রাস্তা তো ছাড়বেন না , আরও বিস্তৃত করতে হবে।’ যদিও পরে এসে তিনি আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন তিনি।

এর আগে, আদালতের রায়ে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার বাধা কাটলেও বৃষ্টির মধ্যে রাজধানীর মৎস্যভবন মোড়ে অবস্থান নেন তার সমর্থকরা। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তারা সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন। সেইসঙ্গে ইশরাক হোসেনের ছবি নিয়ে চলে বিজয় মিছিলের প্রস্তুতি। শত শত মানুষের এই জমায়েতের কারণে মৎস্যভবন মোড় হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সেগুন বাগিচা, পল্টন, জাতীয় প্রেসক্লাব সড়ক, দোয়েল চত্বর, বিজয়নগর সড়ক, তোপখানা রোডের অলি-গলিতে সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত