ঢাকায় আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু সড়ক, যে কোনো ছোট-বড় দাবি আদায়ের প্রয়োজন হলে যখন-তখন সড়ক বন্ধ করে আন্দোলনে নামছেন মুষ্টিমেয় কিছু লোকজন। তাদের কাছে ঢাকার কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ছেন। সড়কে দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে, জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। মানুষ ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠছেন। অন্যদিকে গতকাল সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টিতে নগরীর বহু সড়ক ও অলিগলি ডুবে যায়। বৃষ্টির পানি ও আন্দোলন মিলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
রাজধানীর বাসিন্দারা বলেন, ঢাকায় বৃষ্টি হলেই মূল সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, আর আন্দোলন হলে তো যানজট আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়, চরম দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার সব স্কুল-কলেজ ছিল খোলা। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালতে ছিল ভিড়। সকাল থেকে কর্মজীবী মানুষ যখন সড়কে নেমেছে তখন তাদের দুর্ভোগ শুরু হয়। যানজট ও বৃষ্টির ভোগান্তি মাথায় নিয়ে কর্মস্থলে যান চাকরিজীবীরা।
ঢাকার বাসিন্দা মাহবুব আলম লাবলু তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নগরবাসীর দিকে কারও খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। এত দুর্ভোগ সহ?্য হয় না। শহর অচল। খামার বাড়ি টু ফার্মগেট আড়াই ঘণ্টা। পাবলিক পেটানো শুরু করলে সব দাবি-দাওয়া ঢুকে যাবে। সবাইকে পালাতে হবে মনে রাইখেন।’ মাহবুব আলম লাবলুর পাশাপাশি ঢাকায় বসবারত বহু চাকরিজীবীদের মনের ক্ষোভ এটি। খামারবাড়ি টু ফার্মগেট দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার, যা পায়ে হেঁটে ১৫ মিনিট লাগবে, সেখানে আন্দোলনের কারণে সড়ক অবরোধ থাকায় আড়াই ঘণ্টা লাগছে। ঢাকার এমন চিত্র প্রায়ই ঘটছে।
বাংলামোটরে আটকাপড়া আরেক যাত্রী তানিয়া বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যাব। রিকশা নিয়েছিলাম ওঠার পরই নেমে গেলাম। গলিতে ঢুকেই রিকশা আর সামনে যাচ্ছে না। এভাবে একটা দেশে চলা যায় না। আমরা কী ঘর থেকে বের হবো না? যানজটে আটকে থাকা সিএনজি অটোরিকশা চালক আক্তার হোসেন বলেন, সকাল থেকে মাত্র একটা ভাড়া পেয়েছি। তারপর থেকে যানজটে আটকা। সারা দিন যদি এভাবে সড়কে আটকা থাকতে হয় তাহলে মালিককে গাড়ির টাকা দেব কেমন করে? আর নিজের পরিবারের খরচ তুলবাকেমন করে?
দেশের রাজধানীতে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই গুরুত্বপূর্ণ সড়কে একাধিক ব্যক্তি বা সংগঠন আন্দোলন-বিক্ষোভ করছে। এতে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তীব্র যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে রাজধানী। মানুষের দুর্ভোগের সীমা পৌঁছে চরমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে ক’দিন ধরেই বিক্ষোভ করছে ছাত্রদল। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই শাহবাগ থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করেন তারা। ফলে ওই এলাকায় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথের দাবিতে মৎস্য ভবন মোড় বুধবার থেকে টানা অবরোধ করে রেখেছিলেন তার অনুসারীরা। তবে, গতকাল হাইকোর্টের রায়ের পর এই ইস্যু থেকে সড়ে দাঁড়ান বিক্ষোভকারীরা।
গত কয়েক দিন ধরে সরেজমিন রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা হিসেবে পরিচিত পল্টন, প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক, মৎস্য ভবন, সায়েন্স ল্যাব, পান্থপথ, বাংলামটর, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি। আন্দোলনে শত শত যানবাহন সড়কে আটকে যায়। শাহবাগ থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত বন্ধ থাকায় পাশপাশের অলিগলিও যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শাহবামুখী এবং শাহবাগ থেকে পল্টন-গুলিস্তানমুখী সম্পূর্ণ সড়ক বন্ধ ছিল। গণপরিবহনের চালকরা যানবাহন বন্ধ করে বসে থাকতে দেখা যায়। অধিকাংশ গাড়ি থেকে যাত্রীরা নেমে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বৃষ্টিতে মূল সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতার কারণে রিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে সড়কের মাঝে আটকে থাকতেও দেখা যায়।
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিন সড়ক অবরোধের কারণে আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কাজে আসলেও দিন শেষে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। ফলে গাড়ির মালিককে খরচের টাকা দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। শাহবাগ থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে রওনা করা জিয়াউর রহমান বলেন, আন্দোলনের কারণে প্রতিদিন সড়কে যানজট হচ্ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকছে, গাড়ি না চলায় হেঁটে অফিসে যেতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রমনা জোনের ট্রাফিক সার্জেন্ট নাফিস আহমেদ বলেন, অবরোধের কারণে রাজধানীর সাতটি পয়েন্ট বন্ধ। এখানে আমাদের কোনো উপায় নেই। সড়ক থেকে আন্দোলনকারীরা না সরলে যানজট কমবে না। মূল সড়ক আটকে থাকলে বড় বড় যানবাহন অলিগলিতে ঢুকে যায়। ফলে যানজট আরও বেড়ে যায়।
রাজধানীর ৬০ ফিট এলাকা থেকে পল্টন যাওয়ার উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে গতকাল সকাল ৯টায় বের হন বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বেলা ১টার দিকে তিনি পৌঁছান পল্টনে। মামুন বলেন, ঢাকা এভাবে আর কতদিন চলবে? আমাদের মতো মানুষের কথা কেউ কখনও শুনেছে? কোনো সরকারই আমাদের কথা শোনেনি। সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন আর কতদিন চলবে বলতে পারেন কেউ? আমার মতো চাকরিজীবীদের যদি ৩-৪ ঘণ্টা ধরে অফিসে যেতে হয় তাহলে কীভাবে চাকরি থাকবে? বেসরকারি চাকরিজীবী আল আমিন বলেন, মুগদা থেকে মালিবাগ হয়ে সেগুনবাগিচায় এসেছেন। আধাঘণ্টার রাস্তা আসতে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টার বেশি। মাঝে মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টার ও আশপাশের এলাকায় ছিল হাঁটু সমান পানি। জলাবদ্ধতা আর যানজটে মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। মগবাজার এলাকায় রমনা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী তাসনিম তামিম বলেন, স্কুল থেকে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে যাব সেই উপায় নেই। রাস্তায় পানি আর পানি। তাই জুতা হাতে নিয়ে প্যান্ট উঁচু করে হাঁটছি। গর্তের কারণে হাঁটতেও ভয় করে। মালিবাগের বাসিন্দা আব্দুল হাকিম বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে আমাদের ভোগান্তির শেষ থাকে না। সামান্য বৃষ্টিতেই এলাকার অলিগলির রাস্তাগুলো ডুবে যায়। পুরো এলাকা পানিতে থই থই করে। এর কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক না হলে এই দুর্ভোগ থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
সড়কের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সরওয়ার বলেন, ঢাকায় বিভিন্ন সংগঠনের দাবি-দাওয়ার কারণে অনেক রাস্তায় অবরোধ করে রাখা হয়েছে। এরসঙ্গে বৃষ্টি পড়ায় অনেক সড়ক ডুবে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ট্রাফিক পুলিশেরও দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে, যানজট নিরসনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।