বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পেয়ে দেশের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এরমধ্যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার অন্যতম অঙ্গীকার তার। এছাড়াও বিচারব্যবস্থা সংস্কার এবং আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত করা। কিন্তু গত সাড়ে ৯ মাসের মধ্যেই জুলাই ঐক্যের ফাটলে ঢাকাসহ সারা দেশে ছোট-বড় যেকোনো ইস্যুতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। এতে পদে পদে বাধার মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতা করায় গত বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের চার ঘণ্টা অনির্ধারিত বৈঠকে পদত্যাগের আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার পদত্যাগের গুঞ্জন শুনে যমুনায় যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানান নাহিদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিশ্বাস করায় ড. ইউনূস হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বৈঠকে বলেন, ‘বারবার বলে আসছি, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। জুনের পর একদিনও থাকব না। কিন্তু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন বিষয়কেও নির্বাচনি ইস্যু করে তোলা হচ্ছে’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় সংস্কার অপরিহার্য। আর রাষ্ট্রীয় সংস্কার জটিল ও কঠিন কাজ। সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্পর্কে সবাইকে সম্ভাব্য ধারণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ইস্যুতে ইউনূস সরকার একক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যেকোনো প্রয়োজনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, এনসিপি, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এসব আলোচনার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে, সেটির একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, তাদের মাঝে বিভাজনের সূর তৈরি হয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কার্যক্রম সঠিক পথে এগোতে পারছে না।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির ২৪তম জাতীয় সম্মেলন ও বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভার পর অনেক সময় ধরে তারা আলোচনা করেছেন। তাদের তিনটা কঠিন দায়িত্ব। এর একটি সংস্কার, অন্যটি বিচার, আরেকটি নির্বাচন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যার যত ধরনের দাবি, সব দাবি নিয়ে রাস্তা আটকে দিচ্ছে। এতে ঢাকার রাস্তা একেবারে অচল হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা নিরসনে তারা কিছুই করতে পারছেন না। তাদের দায়িত্ব পালন করা তখনই সম্ভব হবে, যখন তারা সবার সহযোগিতা পাবেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যে প্রতিবন্ধকতাগুলো তৈরি হচ্ছে, তাদের দায়িত্ব পালনে সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবেন কিংবা আদৌ পারবেন কি না, যদি পারেন, সেটা কীভাবে করবেন, আর না পারলে কী করণীয় হবে, সেগুলো নিয়ে তারা চিন্তা করেছেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একটা সময় দিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তার এক দিনও এদিক-সেদিক হওয়ার কোনো সুযোগ তাদের পক্ষ থেকে নেই। কাজেই এগুলো নিয়ে অন্য ধরনের কথা বলারও সুযোগ হওয়া উচিত ছিল না। কারণ, বারবার বলা হচ্ছে যে নির্বাচন নিয়ে একটা সময় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু গুরুদায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো পালনের সঙ্গে মাসের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। তিনি বলেন, তারা যদি দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তাহলে তাদের দায়িত্বে থাকাটা প্রাসঙ্গিক। আর যদি দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে তাদের যার যার নিজস্ব অনেক কাজ রয়েছে। তখন দায়িত্ব পালন করাটা আর প্রাসঙ্গিক থাকল না।
এদিকে রাজধানীর ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড-২০২৫ এর জাতীয় পর্যায়ের মূল পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। অর্থ মন্ত্রণালয় ছাড়াও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেন; অথর্ব বলেন। সমালোচনা করবেন, ঠিক আছে। তবে বাইরে এসব ভালো ইম্প্রেশন দেয় না। ইমেজ (ভাবমূর্তি) ক্ষুণ্ণ হয়।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের বিবৃতি: জাতীয় সংকট মুহূর্তে সর্বসম্মত রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সমঝোতায় পৌঁছাতে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে দ্রুত সংলাপের আহবান জানিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটি আরও জানায়, বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের রূপরেখা হতে পারে সংকট থেকে মুক্তির উপায়। বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশ আজ একটি সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, রাজনৈতিক চেতনা ও সামাজিক সংহতির ভিত্তি এক বহুমাত্রিক বিভ্রান্তি ও টানাপোড়নের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
বিবৃতিতে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় অন্তত ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাতে সকল রাজনৈতিক দল, বিশেষত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দল ও সংগঠনসমূহের মধ্যে জরুরি সংলাপ শুরু করা, বিচারপ্রক্রিয়ায় গতি আনার পাশাপাশি তা যেন পক্ষপাতহীন ও দলীয় প্রভাবমুক্ত হয় তা নিশ্চিত করা, ঐক্য কমিশনের কার্যক্রম দ্রুততর করে সকল দলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে যত বেশি সম্ভব রাষ্ট্র সংস্কার সম্পন্ন করা, একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সময়োপযোগী জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাস্তবমুখী সময়সীমা নির্ধারণ করে কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গঠিত সমস্ত রাজনৈতিক ঐক্য ও রূপরেখাকে পুনর্মূল্যায়ন করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন ভিত্তি তৈরি করার দাবী জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবলমাত্র ঐক্য, বিচক্ষণতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে। দলীয় সংকীর্ণতা নয়, জাতির বৃহত্তর স্বার্থই এখন মুখ্য হওয়া উচিত। বিভাজন নয়, সমন্বয়ই হোক আমাদের মূলমন্ত্র। অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সকলে মিলে এক নতুন, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য রাষ্ট্র বিনির্মাণে নতুন করে শপথবদ্ধ হতে সকল গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তির প্রতি আহ্বান জানায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।
এদিকে জুলাইয়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তির মধ্যে ফাটল তৈরির প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ঢাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে জুলাই ঐক্য ?নামক একটি প্লাটফর্ম। এ সময় আন্দোলনকারীরা- ‘জুলাইয়ের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেবো রক্ত’, ‘আবু সাঈদের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘গোলামী না আজাদী, আজাদী আজাদী’, ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ ইত্যাদি স্লোগান দেন?।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে অস্পষ্টতা এবং রাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার তা সরিয়ে নেন বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তবে তার আগেই বিষয়টি নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। তার সেই ফেসবুকে পোস্টের স্ক্রিনশটও শেয়ার করেছেন অনেকে। ওই পোস্টে বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না বলেই তার বিশ্বাস। তবে বিকেল ৪টার দিকে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। এতে তিনি দাবি করেন, প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে তার দেওয়া আগের পোস্টটি ছিল ব্যক্তিগত মতামত। ওই পোস্টে ফয়েজ আহমদ বলেন, ডিসক্লেইমার, প্রধান উপদেষ্টা স্যারের বিষয়ে দেওয়া স্ট্যাটাসটি আমার ব্যক্তিগত মতামত। এটাকে নিউজ না করার অনুরোধ জানান ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।