প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে দায়িত্বরত সরকারি কর্মচারীরা সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভণ্ডমিছিল করেছেন। গতকাল রোববার সচিবালয়ের পাশাপাশি রাজধানীর আগারগাঁও, সুপ্রিমকোর্টের বার প্রাঙ্গণ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সামনে ভিন্ন ভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন, বিক্ষোভ ও মিছিল করা হয়েছে। তাদের বিক্ষোভ ও আন্দোলনে সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। এতে নাগরিকসেবা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের ব্যানারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেন। আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়াও বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তার সমর্থক ও কর্পোরেশনের বড় একটি অংশের কর্মচারীরা। নগর ভবনের ফটকগুলোতে তালা ঝুলছে। ‘ঢাকাবাসী’র ব্যানারে ইশরাকের সমর্থকরা কিছুক্ষণ পরপর নগর ভবন প্রাঙ্গণে মিছিল করেন। মিছিল শেষ হলে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নানা স্লোগান দেন। পঞ্চম দিনের মতো কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। অন্যদিকে নিজেদের ৬ দফা দাবি আদায়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ করেন স্বাস্থ্যসহকারীরা। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেপ্তারের দাবিতে সুপ্রিমকোর্টে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে সুপ্রিমকোর্ট ইউনিট।
সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ : গত ৫ আগস্টের পর থেকে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে প্রায়ই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। গতকালও সচিবালয়ে কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেন সরকারি কর্মচারীরা। ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদনের প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভণ্ডমিছিল করেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। তারা এই অনুমোদিত খসড়াটিকে ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের ব্যানারে এই আন্দোলন হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। শত শত কর্মচারী দপ্তর ছেড়ে মিছিলে যোগ দেন। মিছিল থেকে ‘অবৈধ কালো আইন মানব না’, ‘লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে’ ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়। মিছিলটি সচিবালয়ের ভেতরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রদক্ষিণ করে। একপর্যায়ে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে সমাবেশ করেন কর্মচারীরা। সেখানে দাবি পূরণ না হলে সোমবার সচিবালয়ের ফটকগুলোর কাছে অবস্থান নেবেন কর্মচারীরা। এসময় কাউকে ঢুকতে এবং বের হতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এসময় কয়েকজন নেতা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর সেখান থেকে মিছিল নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের দপ্তরে যান। অবশ্য তখন তিনি দপ্তরে ছিলেন না। সেখান থেকে বের হয়ে তারা সচিবালয়ে মূল ফটকের কাছে যান। এসময় কিছুক্ষণের জন্য ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর অনুমোদিত অধ্যাদেশের খসড়াকে কালাকানুন আখ্যায়িত করে বলেন, এটি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। এরপর সচিবালয় চত্বরে বাদামতলায় অবস্থান নেন কর্মচারীরা। পরে অবশ্য উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কর্মচারী নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান তাদের বলেছেন দাবির বিষয়টি তিনি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরবেন।
ডিএসসিসিতে বিক্ষোভ : বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে বরাবরের মতো গতকালও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তার সমর্থক ও সিটি কর্পোরেশনের বড় একটি অংশের কর্মচারীরা। কর্মসূচির কারণে গুরুত্বপূর্ণ এসব জায়গায় স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অচল এনবিআর : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বেশিরভাগ শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারী এনবিআরের নিচতলায় প্রধান ফটকের পাশেই অবস্থান নেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় প্রবেশের প্রধান দুই ফটক। এ কারণে এনবিআরের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ ছিল। কয়েক দিন ধরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এ আন্দোলন চলানো হচ্ছে। এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর প্রতিবাদ করে আসছেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রধান ফটকে কারও কারও হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। এনবিআর চেয়ারম্যান নিজের কার্যালয়ে আসেননি। তবে গত বুধবারের মতো গতকালও ভবনের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান নেয় পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য। প্রধান ফটক বন্ধ থাকায় গাড়ি নিয়ে ভবনের ভেতরে ঢোকা না গেলে হেঁটে কর্মকর্তারা ভবনে ঢোকেন। রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কাস্টম হাউস এবং শুল্ক স্টেশন ব্যতীত আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলে। আজও সোমবার আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতীত আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করবেন তারা। দাবি পূরণের আশ্বাসে কর্মবিরতির কর্মসূচি স্থগিত করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
সড়ক অবরোধ করে স্বাস্থ্যসহকারীদের বিক্ষোভ : জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সড়ক অবরোধ করে গতকাল সকাল থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় পরিষদ। কর্মসূচিতে এক হাজারেরও বেশি আন্দোলনকারী অংশ নেন। এসময় তারা রাস্তা অবস্থানের পাশাপাশি সচিবালয় মেট্রোস্টেশনের কনকোর্স প্লাজায়ও চলে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে সড়ক ও মেট্রোরেলের যাতায়াতকারী যাত্রীরা। এসময় মেট্রোর যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা আন্দোলন করবে রাস্তায়। তাদের উপরে কি? তারা রাস্তায়ও থাকবে আবার উপরেও থাকবে! এটা কী ফাজলামো নাকি? যেখানে ইচ্ছা সেখানেই তারা থাকবে। যেদিকে আমার নামার দরকার সেদিকে নামতে পারছি না তাদের জন্য, ঘুরে নামতে হচ্ছে। বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন ছয় দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করে। ১. নিয়োগবিধি সংশোধন করে স্নাতক বা সমমান এবং ১৪তম গ্রেড প্রদান। ২. ইনসার্ভিস ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ সনদ প্রাপ্তদের ১১তম গ্রেড প্রদানসহ টেকনিক্যাল পদমর্যাদা প্রদান। ৩. পদোন্নতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড নিশ্চিত করতে হবে। ৪. স্বাস্থ্য সহকারী, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য পরিদর্শকগণ পূর্বের নিয়োগবিধি দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও সবার প্রশিক্ষণবিহীন স্নাতক পাস স্কেলে আত্তীকরণ করতে হবে। ৫. বেতন-স্কেল উন্নতি বা পুনঃনির্ধারণের পূর্বে স্বাস্থ্য সহকারী বা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক বা স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা যত সংখ্যক টাইম স্কেল (১/২/৩টি) অথবা উচ্চতর স্কেল (১/২টি) প্রাপ্ত বা প্রাপ্য হয়েছেন, তা উন্নীত পুনঃনির্ধারিত বেতন-স্কেলের সঙ্গে যোগ করতে হবে এবং ৬. পূর্বে ইন সার্ভিস ডিপ্লোমা (এসআইটি) কোর্স সম্পূর্ণকারী স্বাস্থ্য সহকারী বা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক বা স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা ডিপ্লোমা সম্পন্নকারী সমমান হিসেবে গণ্য করতে হবে।
পল্লী বিদ্যুৎ কর্মীদের বিক্ষোভ : পঞ্চম দিনের মতো কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন, হয়রানি বন্ধ, মামলা প্রত্যাহারসহ ৭ দফা দাবিতে সারা দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। বিদ্যুৎসেবা চালু রেখে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন কয়েকশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড একীভূত করে অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন এবং অনিয়মিতদের নিয়মিতকরণসহ দুই দফা দাবিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আন্দোলনে নামেন সারা দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৪৫ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী।
সুপ্রিমকোর্টে বিক্ষোভ : সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেপ্তারের দাবিতে সুপ্রিমকোর্টে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। গতকাল রোববার দুপুর ১টায় সুপ্রিমকোর্ট বার প্রাঙ্গণে এ বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে সুপ্রিমকোর্ট ইউনিট। বিক্ষোভ সমাবেশে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর আইন কর্মকর্তাদের পদত্যাগ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও ফ্যাসিবাদের দোসর নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আল মাহবুব।
পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে শিক্ষকরা : চাকরির শুরুতে ১১তম বেতন গ্রেড নির্ধারণসহ তিন দফা দাবিতে ৫ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত দিনে ১ ঘণ্টা, ১৬ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত ২ ঘণ্টা এবং ২১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আজ সোমবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই কর্মসূচি চলবে।