ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আন্দোলনে উত্তপ্ত সচিবালয় কর্মকাণ্ড স্থবির

দুই দিন কলম-বিরতি পালন করবেন সিভিল সার্ভিসের ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা
আন্দোলনে উত্তপ্ত সচিবালয় কর্মকাণ্ড স্থবির

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে টানা কয়েক দিন ধরে সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল করছেন সরকারি কর্মচারীরা। তারা সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-কে কালো আইন উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছাড়াও এতে অংশ নেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। তাদের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সচিবালয়। কর্মচারীদের আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু।

আজ মঙ্গলবার আবারও বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। সচিবালয়ের ভেতর বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। একই সঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি পালনের জন্য সচিবালয়ের বাইরে সারা দেশের সরকারি দপ্তরের কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। গত রোববার রাতে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার। গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে অধ্যাদেশটি অনুমোদনের পর থেকেই গত কয়েকদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অধ্যাদেশ জারির পরদিন সকাল থেকেই সচিবালয়ে ছয় নম্বর ভবনের সামনে বাদামতলায় জড়ো হন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর ও মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর সোয়া ১১টার দিকে তাদের সঙ্গে যোগ দেন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের অপর অংশ। এই অংশে নেতৃত্বে ছিলেন মো. নূরুল ইসলাম এবং মুজাহিদুল ইসলাম। বিক্ষোভ মিছিলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘অবৈধ কালো আইন, বাতিল কর করতে হবে’, ‘কর্মচারী মানে না, অবৈধ কালো আইন’, ‘মানি না মানবা না, অবৈধ কালো আইন’, ‘এক হও লড়াই কর, ১৮ লাখ কর্মচারী’, ‘সচিবালয়ের কর্মচারী, এক হও এক হও’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’- এই ধরনের বিভিন্ন স্লোগান দেন কর্মচারীরা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দপ্তরের কাজ রেখে বিক্ষোভে অংশ নেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তারা সচিবালয়ের ভেতরে প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এসময় প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি অন্যান্য ফটকও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এখন থেকে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সবগুলো সংগঠন মিলে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ নামে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে ঐক্য ফোরামের নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, ‘কর্মসূচি ততক্ষণ পর্যন্ত চলমান থাকবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই ‘কালো’ আইন বা অধ্যাদেশ বাতিল সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার না করা হবে। এই আইন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে চলমান কর্মসূচি সমাপ্ত হবে।’ তিনি মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয় চত্বরের বাদামতলায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।

গতকাল আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় বৈঠকটি সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান বাদিউল কবীর। ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকাংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম বলেন, ?সারা দেশের কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

অধ্যাদেশে যা আছে : অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যে কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। অধ্যাদেশে এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি হতে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা যাবে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে ১৫ লাখের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। আইন অনুযায়ী সবাই কর্মচারী।

দুই দিন কলমণ্ডবিরতি পালন করবেন সিভিল সার্ভিসের ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা : ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর উদ্যোগে ঘোষিত এই কর্মসূচি চলবে ২৭ ও ২৮ মে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। তবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ অন্যান্য জরুরিসেবা এই কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ‘বৈষম্যমূলকভাবে’ সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এবং পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠাসহ কয়েকটি দাবিতে ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা আগামী ২৭ মে থেকে কলম বিরতি কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর উদ্যোগে ঘোষিত এই কর্মসূচি চলবে ২৭ ও ২৮ মে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। সারা দেশে এ সময়ে কর্মসূচিতে অংশ নেবেন সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ অন্যান্য জরুরিসেবা এই কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।

সংগঠনের সভাপতি এম এম রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক ‘বৈষম্যমূলকভাবে’ কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রতিবাদেই এই কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে মারামারি, মিছিল এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে শোডাউনের মতো ঘটনা ঘটান। এমনকি তারা সংস্কার কমিশনকে আল্টিমেটামও দেন। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির পর প্রশাসন ক্যাডার সদস্যরা বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ২৫টি ক্যাডারের ১২ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যদিও সরকারের বিভিন্ন মহল বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলেও দীর্ঘদিন ধরে তা ঝুলে আছে। বরং সম্প্রতি কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চলছে। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত