একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাসের পর মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি) হাসপাতালে ভর্তি থাকাবস্থায় ৭৩ বছর বয়সি আজহারের কারামুক্তি মেলে। পরে হাসপাতালে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কালো রঙের গাড়িতে করে শাহবাগ চত্বরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে বরণ করে নেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘জাতির প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আগামীতে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’ এটিএম আজহারকে ‘মজলুম নেতা’ উল্লেখ করে তিনি যেন দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে পারেন, সেজন্য সবার দোয়া কামনা করেন জামায়াত আমির। তিনি আরও বলেন, দেশের ১৮ কোটি মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এতে কারও একার কৃতিত্ব নেই।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দেন আপিল বিভাগ। সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় ঘোষণা করা হয়। এদিন রাতেই রায়ের অনুলিপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পিজি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে কারা কর্তৃপক্ষ আজহারুল ইসলামের মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ঢাকা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) মো. জাহাঙ্গীর কবির তার মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বুধবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় আজহারুল ইসলামকে।
১৪ বছর কারাভোগের পর বেরিয়ে এসে শাহবাগ চত্বরে এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা যেখানে যে পর্যায়ে জড়িত। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। তা না হলে খারাপ সংস্কৃতি চালু থাকবে, এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ১৪ বছর কারাগারে থাকার পর গতকাল সকালে মুক্তি পেয়েছি। আমি এখন মুক্ত, আমি এখন স্বাধীন। এই স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক এখন।’
মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাসের জন্য উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘তারা (আদালত) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একটা অনন্য ভূমিকা পালন করছেন। এতদিন ন্যায়বিচার ছিল না। আদালতকে ব্যবহার করা হয়েছে। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে জনগণ ন্যয়বিচার যেন পান, সেই ব্যবস্থাই তারা করবেন।’ তার মামলায় আইনজীবী এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে বিপ্লবের নায়কদের ধন্যবাদ জানান তিনি। তাদের আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ছাত্র সমাজই রাজপথে রক্ত ঢেলে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যার কারণে বাংলাদেশ নতুনভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা আমার নেতা ছিলেন, তাদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে।’ এসময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে স্মরণ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদিকে বিনাচিকিৎসায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ, মো. তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ ও ড. শফিকুল শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং দুটি অভিযোগে কারাদণ্ড দেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে একটি থেকে তিনি খালাস পেয়েছিলেন। যে অভিযোগগুলোয় তিনি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল আজহারুল ইসলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং জামায়াত সদস্যদের সঙ্গে মিলে মোকসেদপুর গ্রামে আক্রমণ চালান। তারা বাড়িঘরে লুটপাট চালায়, অগ্নিসংযোগ করে এবং অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন আজহারুল। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আজহারুল ইসলাম রংপুরের ঝাড়ুয়ারবিলের কাছে হিন্দু অধ্যুষিত একাধিক গ্রামে পরিকল্পিত হামলায় অংশ নেন। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত এবং আরও ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়। জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের (জেসিই) অধীনে দোষী সাব্যস্ত হন আজহারুল। মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল আজহারুল ইসলাম রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে চারজন হিন্দু অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে অপহরণ করেন। পরে তাদের হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে রংপুর টাউন হলে বেশ কয়েকজনকে অপহরণ করে আটক রাখা হয়। যেটি ধর্ষণ ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
১৯৭১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দুটি ঘটনায় আজহারুল ইসলাম এক যুবককে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার জন্য চড় দেন এবং পরে তার ভাইকে অপহরণ ও নির্যাতনের নির্দেশ দেন। নির্যাতনে ওই ব্যক্তি স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্বের শিকার হন। এতে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত।