বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ আটকাতে আপিল বিভাগে যে আবেদন করা হয়েছিল, তা পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। এই জটিলতায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারকের আপিল বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এই পর্যবেক্ষণ দেয়। কিন্তু তাতে ধোঁয়াশা কাটেনি, ইশরাক হোসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে বসার সুযোগ পাবেন কি না, তা স্পষ্ট হয়নি।
ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট জারির জন্য নির্বাচন কমিশন মন্ত্রণালয়ের কাছে যে মতামত চেয়েছিল, তা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগ বলেছে, সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দিয়েছে। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ না করে নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। অথচ সংবিধান অনুযায়ী উল্টো নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করার কথা মন্ত্রণালয়ের। শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ইয়াসিন খান বলেন, ইশরাকের বিষয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। লিখিত রায় প্রকাশিত হলে আদালতের পর্যবেক্ষণ জানা যাবে। ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন যে গেজেট জারি করেছিল, আদালত তাতে হস্তক্ষেপ করেনি বলেও মন্তব্য করেন এ আইনজীবী। কিন্তু এ মামলার দুই পক্ষের আইনজীবীরা এ বিষয়ে দুই রকম কথা বলেছেন। রিটকারীর আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালত যেহেতু বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছে, তারা মনে করছেন, ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের জারি করা গেজেটের আর কার্যকারিতা নেই। অন্যদিকে ইশরাকের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলছেন, গেজেট এখনও বহাল আছে। আমরা মনে করি, সরকার তাকে শপথ পড়াবে, এটা সরকারের দায়িত্ব ছিল তাকে শপথ পড়ানো।
এদিকে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে শপথ আয়োজন করে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিলে চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগর ভবনে চলমান বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি। ইশরাক হোসেন বলেন, মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আদালত সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও গড়িমসি করছে এই সরকার। আদালতের নির্দেশনা না মানলে তা হবে অবমাননাকর। তিনি আরও বলেন, একজন মেয়রকে শপথ পড়াতে পারছে না তাহলে ভবিষ্যতে নির্বাচিত তিনশ’ সংসদ সদস্যকে কীভাবে এই সরকার শপথবাক্য পাঠ করাবেন!
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী নগর ভবনের মূল ফটকের ভেতরে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। গত ১৫ দিন ধরে ঢাকাবাসী ব্যানারে হওয়া এই আন্দোলন বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চালিয়ে যান তারা। ঢাকাবাসী ব্যানারে দুই সপ্তাহ ধরে চলে আসা এ কর্মসূচিতে ইশরাকের সমর্থকদের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরাও যুক্ত আছেন। নগর ভবনের ভেতরের ফটকে অবস্থান নেওয়ায় এবং ভবনের সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ায় সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। এ সময় ‘আসিফের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা, মানি না, মানব না’, ‘দাবি মোদের একটাই, মেয়র ছাড়া অফিস নাই’ ‘এক দুই তিন চার, আসিফ তুই স্বৈরাচার’ এমন নানা স্লোগান দিতে শোনা যায়। আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক সাবেক সচিব মশিউর রহমান বলেন, “শপথ নিয়ে টালবাহানা মেনে নেওয়া হবে না। জনতার মেয়র ইশরাক হোসেনকে জনতার দায়িত্ব নিতে দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির সবশেষ নির্বাচন হয়। তাতে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর গত ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল সেই ফল বাতিল করে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে। এরপর ২৭ এপ্রিল ইশরাককে ডিএসসিসি মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাকে যেন শপথ পড়ানো না হয় সেজন্য গত ১৪ মে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদ।
অন্যদিকে ইশরাককে শপথ পড়ানোর দাবিতে ওইদিনই আন্দোলন শুরু করেন তার সমর্থকরা। তাদের আন্দোলনে দুই সপ্তাহ ধরে কার্যত অচল হয়ে আছে নগর ভবন। আইনি জটিলতার কথা বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এখনো ইশরাককে শপথ পড়ানোর আয়োজন করেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার পদত্যাগ দাবি করেন ইশরাক। তার সমর্থকদের আন্দোলনের মধ্যে ‘শপথ না দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে’ দায়ের করা রিট আবেদনটি ২২ মে সরাসরি খারিজ করে দেয় হাই কোর্ট। বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেয়। রিটকারীর এ ধরনের রিট করার এখতিয়ার না থাকার যুক্তিতে আবেদনটি খারিজ করে হাই কোর্ট। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সোমবার আপিল বিভাগে আবেদন করেন রিটকারী আইনজীবী মামুনুর রশিদ। আবেদনে হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চাওয়া হয়। সেই লিভ টু আপিলের শুনানি করে আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার বিষয়টি পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিল।